নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:01 Sep 2022, 06:48 PM
অনলাইনে প্রকাশ্যেই চলছে বন্যপ্রাণীর জমজমাট ব্যবসা
অনলাইনে চলছে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি হচ্ছে পশু-পাখি। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট ইউনিট।
জানা গেছে, মিরপুর-১ নম্বর, টঙ্গী, রামপুরার বনশ্রীসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিন নিয়মিত পশু-পাখির হাট বসে। সেসব হাটে বিভিন্ন প্রজাতির পোষা প্রাণী ছাড়াও ময়না, টিয়া, শালিকসহ নানা ধরনের বন্যপাখি বিক্রি করতে দেখা যায়, যা ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২’ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।
এসব হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অস্থায়ী হাটগুলোতে মূলত বন্য পশু-পাখি বিক্রির সঙ্গে জড়িত দুই ধরনের বিক্রেতা। এর মধ্যে অপেশাদারের সংখ্যা হাতেগোনা হলেও পেশাদার ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। পেশাদার ব্যবসায়ীরা হাটের পাশাপাশি ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি বিক্রি করে থাকে। আবার কেউ কেউ শুধু অনলাইনেই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পশু-পাখিভিত্তিক বাণিজ্যিক বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলেও এ সংক্রান্ত ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, অনলাইনে যেসব ব্যবসায়ী পশু-পাখি বিক্রি করছে, তাদের অধিকাংশের নিজস্ব ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। সেসব পেজ ও চ্যানেলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ময়না, টিয়া, শালিক ও ঘুঘু পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে স্টিল ছবির পাশাপাশি ভিডিও প্রকার করছে তারা।
বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিওতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির খাঁচাবন্দি পাখির দৃশ্য দেখানোর পাশাপাশি দামও উল্লেখ করতে দেখা যাচ্ছে। বিক্রির জন্য পশু-পাখিগুলোর বর্ণনার পাশাপাশি ভিডিওগুলোতে বিক্রেতাদের মোবাইল নাম্বা, এমনকি বাসার ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়। রয়েছে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ সুবিধাও।
ক্যাশ অন ডেলিভারিতে প্রতিটি ময়না পাখি ১০ থেকে ১৬ হাজার টাকা, টিয়া পাখি ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, ঘুঘু জোড়া ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের কাছে এসব বন্য পাখি ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে থাকে বিভিন্ন চক্র। ঢাকাসহ সারা দেশে এই চক্রের জাল বিস্তৃত থাকায় পাখির সরবরাহ এবং বিক্রি বন্ধ হচ্ছে না। বিষয়টি যাদের দেখার কথা বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের; যারা এক্ষেত্রে কার্যত নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।
তারা বলছেন, কোন বাজারে কী কী বন্যপ্রাণী বিক্রি হচ্ছে, কারা বিক্রি করছে- এ সংক্রান্ত নানা তথ্য-উপাত্ত ভিডিওতে রয়েছে। তারপরও কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেভাবে বন্যপ্রাণী ধরা ও নিধন হচ্ছে, তাতে অনেক পাখি এখন বিলুপ্ত প্রায়। এতেও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। এমনকি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টেও ভূমিকা রাখছে এই কার্যকলাপ।
পরিবেশবাদী ৩৩ সংগঠনে গঠিত বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) আহ্বায়ক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, হাটে হোক বা অনলাইনে হোক- বন্যপ্রাণী কেনা-বেচা বন্ধ করা উচিত। আমাদের জোটের ভেতরে থাকা বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার বন বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু তাদের তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। তাদের লোকবল সংকট থাকলে তা বাড়িয়ে ব্যাপক পরিসরে মনিটরিং করা উচিত। এক্ষেত্রে ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, অনলাইনে বন্যপ্রাণী বিক্রির বিরুদ্ধে আমাদের তেমন কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি। আমরা বন্যপ্রাণী বিক্রি এবং ধ্বংসের বিপক্ষে। এ দুটোকে একসঙ্গে দেখি আমরা, সেভাবেই সংরক্ষণ করের দাবি জানিয়ে আসছি। তবে বন বিভাগ নামকাওয়াস্তে কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে এসব বন্ধ হচ্ছে না। আমাদেরও বিষয়টি নিয়ে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত।
পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার (পিএডাব্লিউ) ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, হাট-বাজারের পাশাপাশি অনলাইনে বন্য পশু-পাখি বিক্রি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বন বিভাগকে বহুবার বলা হয়েছে আমাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু তারপরেও এটি বন্ধ হচ্ছে না। এ ব্যাপারে তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব সংগঠন এগুলো নিয়ে কাজ করে তাদেরও আরও সোচ্চার হতে হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, আমরা হাটের পাশাপাশি অনলাইনে বন্যপ্রাণী কেনা-বেচা বন্ধের ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছি। মাঝেমধ্যে এর সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে আসছি। তবে ইচ্ছে থাকলেও জনবল সংকটের কারণে সেভাবে কাজ করা সম্ভব হয় না।
© দিন পরিবর্তন