নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:23 Feb 2024, 11:39 PM
অপচয়ে খাদ্য সংকট
যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বিশ্বব্যাপী চলছে খাদ্যসংকট। এ সংকটকে আরো বেগবান করছে খাদ্য পণ্য নষ্ট ও খাদ্যের অবচয়। এ সমস্যা থেকে উত্তোরণ ও মোকাবিলায় কৃষি সেক্টরের যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগবৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছেন কৃষি ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, খাদ্যের যথাযথ মজুতে হিমাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় প্রয়োগ, যোগাযোগব্যবস্থা অধিকতর আধুনিকীকরণ, ভেবে-চিন্তে কেনাকাটা করা, খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা, খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজারকে কাজে লাগানো, উদ্বৃত্ত খাবারের সঠিক সংরক্ষণের কৌশল সম্পর্কে জানা ও মানা এবং খাবারের অপচয় রোধে সবার সচেতন-সক্রিয়তায় অনেকটাই রোধ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির খাদ্য অপচয় সংক্রান্ত যৌথ গবেষণা বলছে, দেশে ফসলের মাঠ থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছতে প্রতিবছর ৩৭ লাখ টনেরও অধিক খাদ্যশস্য নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে খাবার অপচয়ের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১.০৭ কোটি মেট্রিকটন। সব মিলিয়ে বার্ষিক অপচয় ও নষ্টের মোট পরিমাণ ১ কোটি ৪৫ লাখ মেট্রিকটন। এছাড়া বছরে গড়ে মাথাপিছু ৬৫ কেজি খাবার নষ্ট হচ্ছে। একই গবেষণায় বলা হয়েছে যে, অপচয় ও নষ্ট হওয়া এ পরিমাণ খাদ্য দিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় ৩ মাসের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। অপচয়ের কারণেই আমাদের দেশে চাহিদার চেয়েও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হওয়ার পরও আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। খাদ্য আমদানির বিষয়ে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ ছিল ৪৯ লাখ ৩০ হাজার মে. টন। এক্ষেত্রে চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৫ হাজার মে. টন এবং গম ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার মে. টন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে যে পরিমাণ খাদ্য অপচয় হয় তা দিয়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রায় তিন মাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এটি হচ্ছে দৃশ্যমান অপচয়। খাদ্যের এই দৃশ্যমান অপচয়ের চেয়ে প্রকৃত অপচয় ৭ গুণ বেশি। কারণ খাদ্যের অপচয়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, শ্রম, পানি, জ্বালানি, ভূমি ও পরিবহন সংশ্লিষ্ট অপচয়ও জড়িত।
কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, খাদ্যশস্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করার কারণে অনেক বেশি পরিমাণ নষ্ট হয়। অনেকেই জানেন না যে, সবজি এবং ফলমূল কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় ভালোভাবে পাকার আগে কিংবা বেশি পেকে গেলে তারপর ফসল সংগ্রহ করা হয়। এখানে ঠিকভাবে মানা হয় না পরিপক্বতার নির্দেশনা। এ ছাড়াও সঠিক নিয়ম না মেনে রান্না করা এবং খাবার পরিবেশনের নিয়ম না মানার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য অপচয় বা নষ্টে হচ্ছে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ৩৭তম এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলনে খাদ্য ও পানি সংরক্ষণ এবং খাদ্য অপচয় রোধ শীর্ষক সেশনে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেন, বাংলাদেশে ফসল সংগ্রহের পর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ফসল ও খাদ্য নষ্ট এবং অপচয় হয়। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অপচয়ের পরিমাণ কমাতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে। কৃষিতে সরকারের অগ্রাধিকার হলো ফসলের সংগ্রহ-উত্তর নষ্ট ও অপচয়ের বিশাল পরিমাণ কমিয়ে আনা। সেই লক্ষ্যে সরকার ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের কৃষিযন্ত্র দিয়ে যাচ্ছে এবং বহুমুখী হিমাগার নির্মাণ, বহু ফসলের সমন্বিত সংরক্ষণাগার নির্মাণ ও শাক-সবজি পরিবহনে রেফ্রিজারেটেড ভেহিকল দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। খাদ্য নষ্ট ও অপচয়ের পরিমাণ কমাতে ফসল তোলা, মাড়াই, পরিবহন ও সংরক্ষণে বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে জানান মন্ত্রী।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সমীক্ষায় দেখা গেছে, উচ্চ আয়ের পরিবারে প্রতি মাসে মাথাপিছু ২৬ কেজি খাদ্য নষ্ট বা অপচয় করে। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হচ্ছে। এর প্রায় ২ কোটি ৫২ লাখ মেট্রিক টন চাল মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। বাকি অংশ বীজ, পশুখাদ্য ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার হয়। সমীক্ষা বলছে, বছরে যে ২ কোটি ৫২ লাখ মেট্রিক টন চাল খাবার হিসেবে গ্রহণ করি, তার মধ্যে অজ্ঞতা এবং বিলাসিতার কারণে পারিবারিক পর্যায়ে ৫.৫ শতাংশ অপচয় হয়। যার পরিমাণ কমপক্ষে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার টন। এর মধ্যে খাদ্য সংগ্রহ ও প্রস্তুতি (চাল ধোয়া, রান্না ইত্যাদি) পর্যায়ে ৩ শতাংশ বা ৭ লাখ ৫৬ হাজার টন এবং পরিবেশন ও প্লেট পর্যায়ে ২.৫ শতাংশ বা ৬ লাখ ৩০ হাজার টন অপচয় হয়। সরকারি হিসাবে জনপ্রতি দৈনিক চালের প্রয়োজন ৪০৫ গ্রাম। সেই হিসাবে গৃহস্থালি পর্যায়ের অপচয় রোধ হলে প্রায় ৯৪ লাখ মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর শুধু খাবার টেবিলের অপচয় রোধ হলেই ৪২ লাখ ৬২ হাজার মানুষের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মিটানো সম্ভব।
শস্যদানা হিসেবে চাল, গম ও ডাল এসব উৎপাদন থেকে মানুষের প্লেট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই প্রায় ১৮ শতাংশ অপচয় হয়। ফল আর সবজির ক্ষেত্রে অপচয় হয় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। দেশে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কম, ফলে মাঠ থেকে ফসল তোলা, প্রক্রিয়াকরণ এবং মজুত, তারপর সেগুলো বাজারে পরিবহনের প্রতিটি পর্যায়েই অপচয় হচ্ছে। মোট অপচয়ের হার হিসেবে বাড়ি বা পরিবার থেকে ৬১ শতাংশ, হোটেল বা রেস্তোরাঁ থেকে ২৬ শতাংশ এবং বাকিটুকু বিক্রয় প্রতিষ্ঠান, সুপারশপ, দোকান ও বাজার থেকে নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, সারা পৃথিবীতেই উৎপাদিত খাদ্যের বিরাট একটি অংশ নষ্ট ও অপচয় হয়। বাংলাদেশেও খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্য নষ্ট হয়, যা একদিকে খাদ্য নিরাপত্তায়, অন্যদিকে কৃষকের আয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খাদ্য নষ্ট হওয়া এবং অপচয় কমিয়ে আনতে সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং অ্যাগ্রো-প্রসেসিংয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য সরকার বেশ কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
অ্যাকশন এইডের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। এর পরই রয়েছে রেস্তোরাঁ। এ ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। বুফে রেস্টুরেন্টেও খাবার নষ্ট হয়। একটি বুফে তাদের দৈনিক খাদ্যের বর্জ্য পরিমাপ করেছে ২৯ কেজি, যা সহজেই ৮৫ থেকে ৯০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে পারত। কখনো কখনো এই পরিমাণ আরও বেশি হয়।
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, আমাদের উৎপাদিত ফসলের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নানাভাবে অপচয় হচ্ছে। এখানে উৎপাদন, পরিবহন ও বাজারে যে পরিমাণ নষ্ট যাচ্ছে, তার দাম যোগ হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। মূলত খাদ্যের এই অপচয়ের মূল কারণ হচ্ছে মাঠ থেকে সনাতন পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহ। ইদানীং ধান ও গম সংগ্রহে কম্বাইন্ড হারভেস্টরের মতো আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহার শুরু হলেও অন্যান্য ফসলে আগের পদ্ধতিই রয়ে গেছে। অপচয় কমাতে অন্যান্য ফসল সংগ্রহেও যান্ত্রিকতায় গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাইস মিলে মোটা চাল মেশিনে কেটে তৈরি করা হয় সরু চাল। এখানে চালের একটা বিশাল অংশের অপচয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে শুধু সরকারের নয়, সাধারণ জনগণের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া জরুরি।
খাদ্যপণ্য অপচয় প্রসঙ্গে এসিআই অ্যাগ্রো বিজনেসেস-এর প্রেসিডেন্ট ড. ফা হ আনসারী বলেন, আমাদের দেশে এখনও ৮০ ভাগ মানুষ সনাতন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিলে আসা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয় কৃষিপণ্যের বা খাদ্যের অপচয়। এই অপচয় কমানোর জন্য কৃষির সকল পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এক কথায়, খাদ্যের অপচয় রোধে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নাই। আমাদের সবচেয়ে বেশি অপচয় হয় খাদ্য বা কৃষি পণ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতিতে সংগ্রহের ক্ষেত্রে ১৩ শতাংশ অপচয় হয়, আর যন্ত্র ব্যবহারে অপচয় হয় ২-৩শতাংশ। এর পরেই পরিবহন, সংরক্ষণ, ফুড প্রসেসিংয়েও খাবার অপচয় হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে বেশি ক্ষতি বা অপচয় হয় কিচেন বা রান্না ঘরে। আমাদের কৃষি জমি তৈরি করা থেকে বীজ বপন, সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াইয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে (ফুড প্রসেসিং) খাদ্য তৈরি বা খাদ্য বহুমুখীকরণেও অধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই খাদ্য ও কৃষি পণ্যের অপচয় রোধ করে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উšে§াচিত হবে খাদ্যপণ্য রফতানির দ্বারও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশে কয়েকটি ধাপে খাদ্যের অপচয় হয়। তবে ফসলের ক্ষেত থেকে খাদ্যসামগ্রী বাজারে এসে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি অপচয়টুকু হয়। এর মধ্যে ফসল তোলার পর্যায়ে এক ধরনের অপচয় হয়, এরপর মজুদ বা সংরক্ষণ করা এবং ব্যাপারীর মাধ্যমে সেটি বাজারজাত করার সময় আরেকবার অপচয় হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যখন বড় শহরে ফসল, সবজি ও ফল, মাংস, ডিম, বা দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আসে তখন আরেক দফায় অপচয় হয়।
তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতিব ছর যত খাদ্য উৎপাদন হয়, এর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। নষ্ট হওয়া এই খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টন। খাদ্য অপচয়ে উন্নত দেশের মতো উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোও পিছিয়ে নেই; সেখানে অপচয়ের মূল কারণ মাঠ থেকে খাদ্যশস্য তোলা, প্রক্রিয়াকরণ এবং মজুতের প্রাচীন পদ্ধতি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাঠ থেকে ফসল তোলা, প্রক্রিয়াকরণ ও মজুত, এরপর সেগুলো বাজারে পরিবহন প্রতিটি পর্যায়েই অপচয় হচ্ছে।
© দিন পরিবর্তন