নিজস্ব প্রতিনিধি
Published:04 Feb 2024, 04:15 PM
অপরিকল্পিত হ্রদের বাঁধ কাটায় নিন্মাঞ্চল প্লাবিতঃ ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি
তৌহিদুল ইসলাম কায়রু, চট্টগ্রাম দক্ষিণ :
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বনভূমিতে মাছ চাষের হ্রদ সৃষ্টির জন্য অবৈধভাবে তৈরি একটি কৃত্রিম বাঁধ কেটে দেয় বন বিভাগ। আকস্মিক বাঁধ কেটে দেওয়ায় হ্রদের পানিতে তলিয়ে যায় আশপাশের লোকালয়সহ বিস্তির্ণ এলাকা। এতে শতাধিক বসতি, গবাদি পশু, ফসলের ক্ষেত, সড়ক-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গভীর রাতে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের।
শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে লোহাগাড়া ও পাশের সাতকানিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। পূর্ব প্রস্তুতি ও সতর্কতা ছাড়াই বন বিভাগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয় প্রশাসন। ভোগান্তিতে পড়া লোকজনও ক্ষোভ জানিয়েছেন।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া বনাঞ্চল সংলগ্ন সোনাকানিয়া ছড়ায় কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের জন্য একটি হ্রদ তৈরি করা হয়। বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ ফুট এবং প্রস্থ ২০ ফুট ও উচ্চতা ১০০ ফুট।
শনিবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সদ্যসাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভীর ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা বাঁধ নির্মাণ করেন। কৃত্রিম বাঁধের কারণে বড়হাতিয়া বনাঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ছড়ার পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ায় আশপাশের ফসলি জমির চাষাবাদও বন্ধ হয়ে আছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর শনিবার বিকেলেই কৃত্রিম বাঁধটি কেটে দেওয়ার কাজে নামে বন বিভাগ। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক (পদুয়া) মো. দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৬০ জন বনকর্মী ও ৩০ জন শ্রমিক বাঁধ কাটার কাজ শুরু করেন। রোববার ভোর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে বাঁধের প্রায় ৭০ ফুট অপসারণ করা হয়। পানির তোড়ে ভেঙ্গে যায় আরও প্রায় ৩০ ফুটের মতো।
সহকারি বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ’৭০ ফুটের মতো আমরা কেটেছি। পানির তোড়ে আরও কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে। টোটাল কী পরিমাণ বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে, সেটা জানতে আমাদের আরও একটু সময় লাগবে। ভোরে আমরা ফিরে এসেছি। এ মুহুর্তে বাঁধ অপসারণ সংক্রান্ত কার্যক্রমের আর প্রয়োজন নেই।’
জানা গেছে, বাঁধ কেটে দেওয়ার পর শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে হ্রদের পানির ঢল লোহাগাড়ার বড়হাতিয়ার পাশাপাশি সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়ে। গ্রামীণ সড়ক, ফসলের ক্ষেত তলিয়ে, ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে রীতিমতো বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানির তোড়ে সাতকানিয়ায় কালামিয়া পাড়া ও মির্জাখীল দরবার এলাকায় দু’টি স্লুইচগেট ভেঙে যায়।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ২টি ওয়ার্ডে প্রায় ৬০টির মতো মাটির বসতঘর ভেঙ্গে গেছে। ধানের বীজতলা, শস্যক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামীণ সড়কগুলোর ইট উঠে গেছে। কয়েকটি কালভার্টও ভেঙ্গেছে। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি অফিসার সংশ্লিষ্ট এলাকায় গেছেন। কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা নিরূপণ করে আমরা পদক্ষেপ নেব।’
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ ইনামুল হাছান বলেন, ‘বড়হাতিয়া এলাকায় কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে আমাদের এলাকা যেহেতু পাহাড়ি উঁচু এলাকা, এখানে ক্ষতি বেশি হয়নি। সাতকানিয়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।’
স্থানীয় প্রশাসন আকস্মিক এ পরিস্থিতির জন্য বন বিভাগের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তকে দায়ী করছে। তারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় না করে হুট করে বাঁধ কেটে দিয়ে বন বিভাগ নিজেই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
সাতকানিয়ার ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘হুট করে বাঁধটা কেটে দেওয়া সঠিক হয়নি। এ জন্য পানি তোড়ে এমন বন্যা পরিস্থিতি হয়েছে। শীতের মধ্যে লোকজনকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে ভোরের দিকে পানি নেমে গেছে।’
লোহাগাড়ার ইউএনও মোহাম্মদ ইনামুল হাছান বলেন, ‘বন বিভাগের জায়গায় বাঁধ, উনারা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু তিন বছর ধরে যে কাজটা করেনি, সেটা করার আগে অন্তঃত তিনদিন সময় নেওয়া উচিৎ ছিল। আমরা বারবার বলেছি, কিন্তু উনারা আমাদের কোনো কথাই শোনেননি। বাঁধ কেটে দিলে অন্য কোনো জটিলতা তৈরি হবে কি না, সেটা উনারা বিবেচনায় নেননি। আমি জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদন দেব।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারি বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘হুট করে বাঁধ কাটা হয়নি। ধীরে ধীরে আমরা পানি ছেড়েছি। আশপাশের কিছু ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে এখন কোনো ফসল নেই। কারণ, ধান উঠে গেছে, মাঠগুলো খালি পড়ে আছে। অন্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেগুলোর সত্যতা নেই।
© দিন পরিবর্তন