নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:13 Jul 2022, 05:35 PM
অপসাংবাদিকতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন
ভেজালে সয়লাব বাজার, পণ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে ভেজাল রয়েছে বিভিন্ন পেশায় এমনকি প্রতিষ্ঠানেও। বর্তমানে নকলের ভিড়ে আসল চিনতে বেগ পেতে হয় জনসাধারণকে। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় ভুয়া ডাক্তার, আইনজীবী, মেজর, সচিব এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রশাসন কিংবা জনগণের জালে ধরা পড়ে। অপরদিকে অনুমোদনহীন অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বিভিন্ন এজেন্সি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কারখানাসহ নানা ধরনের অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে প্রশাসন। বৈধ প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মের বাইরে কাজ করলে তাও সিলগালা করতে দেখা যায়। ডাক্তার হতে হলে সরকারি স্বীকৃত মেডিকেল থেকে এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। আইনজীবী হতে হলে অ্যাডভোকেটশিপ পাস করে বার কাউন্সিলের সনদ অর্জন করতে হয়। অনুরূপভাবে একটি প্রতিষ্ঠান করতে হলে প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর, সংস্থা কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হবে। সব পেশায় আলাদা নিয়মনীতি, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কিংবা সেবা প্রধান করলে সব পেশায় রয়েছে সম্মান। তার মধ্যে সাংবাদিকতা মহান ও ক্রিয়েটিভ পেশা। সাংবাদিকদের প্রতি সবারই রয়েছে আলাদা সম্মান। একজন পেশাদার সাংবাদিক তার লেখনীর মাধ্যমে সত্য ও সুন্দরের সন্ধান করে। তুলে ধরে সমস্যা, সম্ভাবনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, উন্নয়ন, অগ্রগতি। একজন প্রকৃত সাংবাদিক দেশকে বহির্বিশ্বে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা রাখে। দেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এই পেশায় জড়িত আছেন। সফল ভাবে সাংবাদিকতা করার ফলস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন অনেকেই। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ ও মিল্লাত নামক পত্রিকার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের কথা, বাংলার মানুষের কথা তুলে ধরতে তিনি সবার সহযোগিতা নিয়ে প্রেস চালাতেন। মান-উন্নয়ন, গবেষণা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ওপর উচ্চ ডিগ্রি রয়েছে।
কিন্তু সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উঁচু মাপের এই পেশাকে খুবই হাস্যকর করে তুলেছে স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারা তথাকথিত সাংবাদিকরা। আমার মনে হয়, বর্তমানে খুবই সহজ একটি পেশা এটি। যে কেউ চাইলে যখন-তখন এখানে আগমন করতে পারে। লাগে না কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা পূর্বের অভিজ্ঞতা। প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি এ কথা। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, বর্তমানে আন্ডার মেট্রিক অনেকেই পত্রিকার সম্পাদক বনে যাচ্ছেন! ভুয়া এসব পত্রিকার পাঠক না থাকলেও সারা দেশে সংবাদদাতা নিয়োগ করে বাণিজ্যে লিপ্ত হয় তারা। দৈনিক ৮/১০ কপি পত্রিকা প্রিন্ট করে নিজেদের কার্য ও স্বার্থ হাসিলের লক্ষে প্রেস লেখাযুক্ত গাড়ি, আইডি কার্ড, এমনকি ভিজিটিং কার্ড ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত। সাংবাদিকতার পরিচয়ে অবৈধ পণ্যের ব্যবসা, নারী কেলেঙ্কারি, অনৈতিক সুবিধা নিতে গিয়ে অনেক অখ্যাত সংবাদপত্রের মিডিয়াকর্মী ধরা পড়ে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং অনলাইন টিভিগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। বর্তমানে সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। হাতের মুঠোয় বিশ্ব। খুব সহজে, কম খরচে, ঘরে বসে অনলাইন মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, মানসম্মত নিউজ পোর্টালের ভিতর হাজারো নিম্নমানের পোর্টাল জায়গা করে নিয়েছে। এসব তথাকথিত নিউজ মাধ্যমগুলো মনগড়া, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, অশ্লীল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সস্তা জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্যে জীবিত মানুষকে মৃত বানানো, অশ্লীল ও রসালো হেডলাইন দিয়ে সংবাদ, মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদ কপি করা, অনৈতিক সুবিধা না পেলে সম্মানিত ব্যক্তিগণের নামে মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ প্রচার করে হেয় প্রতিপন্ন করা, বিভিন্ন গুজব তথ্য দিয়ে সমাজে, মানুষে, ধর্মে, গোত্র-বর্ণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে ভূমিকা পালন করছে এসব তথাকথিত মিডিয়া ও এর নামধারী সাংবাদিকেরা। জরিপ চালালে দেখা যাবে তাদের কেউ গার্মেন্ট শ্রমিক, দোকান কর্মচারী কিংবা দৈনিক মজুরিতে কাজ করা কর্মচারী থেকে হাজার পাঁচেক টাকা খরচ করে একটি পোর্টাল তৈরি করে কিংবা অনেকে ফেসবুকে পেজ, ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে অনলাইন টিভি নাম দিয়ে সাংবাদিকতায় পদার্পণ করেছে। এটি এই মেধাবী পেশাটির জন্য খুবই নেতিবাচক এবং দেশ ও জাতির জন্য ও ক্ষতিকর।
একজন সাংবাদিককে সৃজনশীল, শিক্ষিত, দেশ-বিদেশ, রাজনৈতিক, বাণিজ্যসহ বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী সত্য-মিথ্যার যাচাই না করে অখ্যাত মিডিয়ার ভুয়া সংবাদগুলো পড়া, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিয়ে তাকে; পরে এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত। তাই পাঠক সমাজেরও সতর্ক থাকতে হবে যা দেখলাম কিংবা পড়লাম তা সাথে সাথে বিশ্বাস না করে কয়েকটি মূলধারা গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচার করেছে কিনা তা দেখতে হবে। বলতে গেলে বর্তমানে মূলধারার গণমাধ্যমের পেশাদার সাংবাদিকদের চেয়ে তথাকথিত মিডিয়ার ভুয়া গণমাধ্যমকর্মীদের দৌড় বেশি।
বর্তমানে এমন অবস্থায় পেশাদার সংবাদকর্মীরা রীতিমতো বিব্রত। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট গণমাধ্যম সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা অধিদপ্তরসমূহ, পেশাদার সাংবাদিকদের প্রেস ক্লাব, ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। তবু যে হারে অখ্যাত সাংবাদিক বেড়ে চলেছে, তাতে এই পেশাটি হুমকির মুখে পড়বে। দেশে নামে-বেনামে গড়ে ওঠা হাজারো পত্রিকা থাকলেও বিশ্বের সেরা সংবাদমাধ্যম তথা দ্য গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি সংবাদমাধ্যম গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারের উচিত দৈনিক কাকের ডাক, কলাপাতা ডটকম, কচু টিভিসহ (ছদ্মনাম) হাজারো ভূঁইফোঁড়, অখ্যাত মিডিয়া বন্ধ করে সাংবাদিকতায় প্রবেশের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া। যে কেউ চাইলে যেনতেনভাবে অনলাইন, প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া খুলে বসতে না পারে, সে বিষয়ে নজরদারি ও নিয়মনীতি প্রয়োজন।
© দিন পরিবর্তন