নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:18 Aug 2022, 07:21 PM
অ্যাপে আগ্রহ কম কৃষকের
সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে দাম বেশি থাকায় অ্যাপে ধান বিক্রিতে আগ্রহ নেই কৃষকের। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরাসরি ধান কিনতে পারছে না সরকার। গত কয়েকটি সংগ্রহ মৌসুমে দেখা গেছে এই চিত্র। তবে খাদ্য কর্মকর্তারা অ্যাপে ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিকে সফল বলে দাবি করেছেন।
সরকারিভাবে ধান কেনার ক্ষেত্রে কৃষকের সময়, খরচ ও হয়রানি কমাতে ২০১৯ সালে অ্যাপ চালু করে সরকার। আমন মৌসুমে ১৬টি উপজেলা দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার এ কার্যক্রম শুরু হয়। এখন ২৫৬টি উপজেলায় অ্যাপের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে। চলতি অর্থবছর নতুন ৪৮টি উপজেলা নিয়ে মোট ৩০৪টি উপজেলায় অ্যাপে ধান কেনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে খাদ্য বিভাগ।
অন্যদিকে মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহেও ‘ডিজিটাল চাল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা’ চালু করা হয়। এরই মধ্যে ৫৩টি উপজেলায় এ ব্যবস্থাপনায় চাল সংগ্রহ করছে সরকার। চলতি অর্থবছর নতুন ৩২টিসহ এ ব্যবস্থা মোট ৮৫টি উপজেলায় উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরকার বোরো ও আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান ও চাল কিনে মজুত করে। এ মজুত থেকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্রদের খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) মাধ্যমে চেষ্টা করা হয় বাজার নিয়ন্ত্রণের।
খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা একটি সফল কর্মসূচি। প্রচার-প্রচারণা, কৃষি বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষকরা এরই মধ্যে বিষয়টি বুঝে উঠেছেন। কিন্তু বাজারের তুলনায় সরকারকে ধান দেওয়া লাভবান না হওয়ায় কৃষকের সাড়া মিলছে না। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম কম থাকলে তখন অ্যাপের সুফল পাওয়া যাবে।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে সরকারিভাবে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান ও সাড়ে ১৩ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সবশেষ ১১ আগস্ট পর্যন্ত ২ লাখ ৩২ হাজার টন ধান ও সাড়ে ৯ লাখ টনের মতো চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান ও ৭ মে থেকে চাল কেনা শুরু হয়। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ধান ২৭ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহ চলবে। এখন বাকি এই কয়েকদিনের মধ্যে ধানের লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাজারে ধানের কেজি ২৯ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দাম ২৭ টাকা। তাই সরকারি গুদামে ধান দিতে কৃষকের আগ্রহ নেই। গত আমন মৌসুমেও তিন লাখ টন ধানের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৮৪ হাজার ৪৭০ টন সংগ্রহ করতে পেরেছিল খাদ্য অধিদপ্তর।
খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ) মো. রায়হানুল কবীর বলেন, আমরা আড়াই লাখ টনের মতো বোরো ধান সংগ্রহ করেছি। এর অর্ধেক এসেছে অ্যাপের মাধ্যমে। অ্যাপে ধান-চাল সংগ্রহের কর্মসূচিটি সফল। এটি খুব ভালোভাবে চলছে। কৃষকরা সাড়া দিচ্ছেন। তাই চলতি অর্থবছর অ্যাপের মাধ্যমে ধান-চাল কেনার কর্মসূচিটি আরো সমপ্রসারিত হবে।
তিনি বলেন, আমাদের কৃষি বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, খাদ্য বিভাগ সবাই এ বিষয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। কৃষকদের পরামর্শ ও সচেতন করতে কার্যক্রম চালিয়েছে। কৃষকদের ডেকে এনে রেজিস্ট্রেশনও করিয়েছে। তবে সিস্টেমটি কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা নির্ভর করছে বাজারমূল্যের ওপর। কারণ সরকারের দেওয়া দামে কৃষক লাভবান না হলে তারা তো ধান দেবে না। সেটা অ্যাপে হোক কিংবা আগের সিস্টেমে হোক।
শেরপুরের নলিতাবাড়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, পুরোনো ব্যবস্থার চেয়ে অ্যাপে ধান-চাল কেনার সুবিধা অনেক বেশি। এটা অত্যন্ত সুন্দর ব্যবস্থা। কৃষককে একবার নিবন্ধন করলেই হয়। শুধু সিজন এলে তারা আবেদন করবে। অ্যাপ চালুর অনেকদিন তো হয়ে গেছে, কৃষকও ব্যবস্থাটি বুঝে উঠেছেন। যদিও ব্যাপকভাবে তারা এটি এখনো বুঝে উঠেননি। যারা সচেতন তারা এরই মধ্যে এ ব্যবস্থায় চলে এসেছেন, এর সুবিধা নিচ্ছেন। কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর পাল্লায় পড়তে হচ্ছে না কৃষককে। তবে সরকারি দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি থাকলে কৃষক তখন ধান দিতে আগ্রহী হন না।
বর্তমানে ২৫৬টি উপজেলায় ‘কৃষকের অ্যাপ’ ও ৫৩টি উপজেলায় ‘ডিজিটাল চাল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা’ চালু রয়েছে। আগামী আমন সংগ্রহ মৌসুমে কৃষকের অ্যাপের মাধ্যমে ধান সংগ্রহের জন্য প্রতিটি বিভাগ থেকে নতুন দুটি করে ১৬টি উপজেলা এবং বোরো সংগ্রহ মৌসুমে প্রতিটি বিভাগ থেকে নতুন চারটি করে ৩২টি উপজেলার নাম চাওয়া হয়েছে চিঠিতে। এতে মোট ৩০৪টি উপজেলায় কৃষকের অ্যাপ সমপ্রসারিত হবে।
অন্যদিকে আগামী আমন সংগ্রহ মৌসুমে ডিজিটাল চাল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চাল সংগ্রহের জন্য প্রতিটি বিভাগ থেকে নতুন আরো দুটি করে ১৬টি উপজেলা এবং আগামী বোরো সংগ্রহ মৌসুমে প্রতিটি বিভাগ থেকে নতুন দুটি করে ১৬টি উপজেলার নাম চাওয়া হয়েছে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে। এতে মোট ৮৫টি উপজেলায় ডিজিটাল চাল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা সমপ্রসারিত হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, অ্যান্ড্রয়েড ফোনের প্লে-স্টোর থেকে ‘কৃষকের অ্যাপ’ ডাউনলোড করা যায়। মোবাইল ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিয়ে প্রথম ধাপের নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে বিভাগ-জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নের নাম, জন্মতারিখ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড নম্বর ও জমির পরিমাণ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হয়। নিবন্ধনের আবেদনের পর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই করেন।
প্রতিটি মৌসুমে নিবন্ধন করা কৃষককে ওই মৌসুমে ধান বিক্রির জন্য আবেদন করতে হবে না। শুধু পুরোনো নিবন্ধিতদের ধান বিক্রির জন্য আবেদন করতে হয়।
ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা, আবেদনকারীর সংখ্যা ও ধানের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। আবেদনকারী বেশি হলে কৃষক নির্বাচন করা হয় লটারির মাধ্যমে। ধান বিক্রির আবেদনের পর উপজেলা সংগ্রহ ও মনিটরিং কমিটি খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের মাধ্যমে লটারি সম্পন্ন করেন। লটারিতে নাম ওঠা কৃষকরা বরাদ্দ পাওয়া ধান সরবাহের জন্য এসএমএস পান। কৃষক অ্যাপে প্রবেশ করেও বরাদ্দের পরিমাণ দেখে নিতে পারেন। নির্ধারিত মান অনুযায়ী ধান সরবরাহের পর কৃষকের ব্যাংক হিসাবে মূল্য পরিশোধ করা হয়।
© দিন পরিবর্তন