logo

আজ থেকে শুরু এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:19 Jul 2022, 12:38 PM

আজ থেকে শুরু এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং


জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য গতকাল সোমবার থেকে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি আজ মঙ্গলবার থেকে দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করা হবে। আর সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার কথাও ভাবছে সরকার। এছাড়া রাত ৮টার পর শপিংমল বন্ধসহ কমানো হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অফিসে কর্মঘণ্টা। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কিছু কার্যক্রম ভার্চুয়ালি করার সুপারিশও করা হয়েছে। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে করণীয় নির্ধারণে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান।

এদিকে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হলেও সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের পাওনা ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। উৎপাদন কেন্দ্রের পরিচালকরা বিদ্যুতের মূল্য বাবদ সরকারের কাছ থেকে তাদের পাওনা এখনো বুঝে পাননি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ সপ্তাহে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আংশিক বকেয়া বিল পরিশোধ করেছে।

এ ব্যাপারে দেশের বিদ্যুৎখাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, মার্চ থেকে শুরু করে চলতি মাস পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের বিপরীতে কোনো পেমেন্ট পাইনি। আমাদের মধ্যে অনেকে ফেব্রুয়ারির বিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পেমেন্ট পেয়েছি। কিন্তু অনেকে সেটাও পাননি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যোগাযোগ করায় বিলের নিষ্পত্তি নিয়ে শিগগির একটি চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যাবে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বিপিডিবি প্রতি মাসে ৪ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ ক্রয় করে। মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুনের বিল বাকি পড়েছে। এ ছাড়া, কিছু প্রতিষ্ঠানের ফেব্রুয়ারির বিলও আংশিকভাবে মেটানো হয়েছে। সেই হিসাবে পুরো বকেয়া বিলের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হবে বলে জানান কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের স্বত্বাধিকারী কনফিডেন্স গ্রুপের পরিচালক ইমরান করিম।

কয়েক মাস ধরে বিপিডিবি নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সম্প্রতি তারা মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করেছে। বিপিডিবি বিআইপিপিএর দেওয়া হিসাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জানায়, তারা সাধারণত বিল জমা পড়ার পর বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য ৪৫ দিন সময় পায়।

বিপিডিবির জনসংযোগ পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, যদি এভাবে বকেয়ার হিসাব করা হয়, তাহলে পরিমাণটি আড়াই মাসের মতো হবে। বিপিডিবি ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারির বকেয়ার বেশিরভাগ অংশ পরিশোধ করেছে।

বিপিডিবির আনুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট, যার মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত উৎপাদন ছিল ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। বাকি ২ হাজার ৮৮৭ মেগাওয়াট ‘ক্যাপটিভ’ উৎপাদন, যেটি মূলত শিল্প খাতের মালিকরা তাদের নিজেদের কারখানা চালানোর জন্য উৎপাদন করে থাকেন।

গত ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যেটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, দেশে এ মুহূর্তে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১০ হাজার ৪৫৩ মেগাওয়াট (প্রায় ৪১ শতাংশ)। ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াটের মধ্যে ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ (১১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট) সরকারি খাত থেকে এবং বাকি ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ (১১ হাজার ১০৮ মেগাওয়াট) বেসরকারি খাত থেকে এসেছে।

বিপিডিবির নথি থেকে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারকে মোট ৭১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে, যার মধ্যে ৪৪ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য খরচ করা হয়েছে।

বেসরকারি খাতের ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) এবং ছোট আইপিপি কারখানায় মোট উৎপাদনের ৩৮ শতাংশ (৮ হাজার ৮০৭ মেগাওয়াট) উৎপাদিত হয়। এই খাতে মোট ব্যয় ৩৭ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা।

বিআইপিপিএ কর্মকর্তারা জানান, বকেয়া পেতে দেরী হওয়াই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তাদের একমাত্র সমস্যা নয়। বিআইপিপিএ’র প্রেসিডেন্ট ইমরান বলেন, ডলারের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকে ডলারের স্বল্পতা ও বিদেশি ঋণদাতাদের ও যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের প্রাপ্য অর্থ সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় আরোপিত জরিমানা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিছু এলসি কয়েক মাস আগে ব্যাংকে খোলা হয়েছে, যখন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। ডলারের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় তাদেরকে এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ৯৫ টাকা বা তারচেয়ে বেশি হার ধরে হিসাব করতে হচ্ছে। কিছু ব্যাংক সরকারের নির্ধারিত হারে ডলার বিক্রি করতেও রাজি হয় না। অনেক বিদেশি ব্যাংক আইপিপি পরিচালকদের অর্থ পরিশোধে দেরীর কারণে অতিরিক্ত চার্জ নেয়। সমপ্রতি যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীরাও একই চর্চা চালু করেছে।

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কোন সময় নাগাদ স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছেন, জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে জ্বালানির মূল্যের ওপর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ববাজারে এর দাম কমার ওপর নির্ভর করছে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নয়ন।

পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে আলোচনা করব। পাম্প মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হলে তা কয়দিন বা কতক্ষণ বন্ধ থাকবে, আমরা সময়সহ বিস্তারিত জানিয়ে দেবো।

অন্যদিকে মসজিদে এসি বন্ধ রাখার ঘোষিত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। গতকাল বিকেলে জানানো হয়, মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে এসি একেবারে বন্ধ করা হবে না বলে জানান বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, শুধু নামাজের সময় মসজিদে এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে উপাসনার সময় এসি চলবে।

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি মসজিদের এসি বন্ধ রাখা হবে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকে প্রশ্ন তুলেন, সরকারি অফিস-আদালত, বিভিন্ন মার্কেটে যেখানে প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যয় করে এসি চলে সেখানে বন্ধ না করে মসজিদের এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, করোনার অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন। সারা দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, উৎপাদন হচ্ছে তার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ কম, যা লোড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে।

এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকারি অফিসের সময় কমিয়ে ৯টা থেকে ৩টা করা হতে পারে। অফিসের নতুন কর্মঘণ্টা নিরুপণ করে শিগগিরই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। এছাড়া বাসা থেকেও অফিস করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুতই সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।

অফিস সময় কমানোর প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, অফিস সময় কমানো হতে পারে অথবা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করা হতে পারে। অফিসে যতটুকু না করলেই না এমনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার বিষয়টি চিন্তা করছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে জানাবো। মানুষের কষ্ট যাতে না হয় সেটা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেব। এটা আলোচনা পর্যায়ে আছে। কেউ বলছে অফিস সময় ৯টা থেকে ৩টা বা ৪টা। তবে এটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা চলছে। যেটা করলে ভালো হয় সেটাই করবো। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সিদ্ধান্তটা আমরা নেব। আমরা সব বিষয় বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করবো।



© দিন পরিবর্তন