দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:22 Dec 2023, 04:56 PM
আমার এই দেশেতে জন্ম
হঠাৎ গ্রামের বাড়িতে পাক সেনারা ঢুকেছে। তিনজন হবে। তবে একজনের ঘাড়ে বন্দুক নেই। আমার সঙ্গে সেলিম ও শাহীন। ওরা আমার আপন ছোট ভাই। তাদের বয়স তখন দুই এবং তিন বছর!
যার ঘাড়ে বন্দুক নেই সে কী যেন জিজ্ঞেস করলো অন্য দুইজনকে এবং তারা যে কী উত্তর দিল বুঝলাম না। কারণ তাদের কারো ভাষা আমার বোঝার উপায় ছিল না। বুঝব কেমন করে? আমার বয়সও খুব একটা বেশি না, ৯-১০ বছর। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কয় ভাইবোন, বাবা কোথায় কী করে ইত্যাদি।
যাক ভালো যে একজন বাংলা বলতে পারে। আমি বললাম বাবা পুলিশে চাকরি করেন এবং তিনি ফরিদপুরে, বড় ভাই ক্যাডেট কলেজে, মেঝো ভাই বাবার ওখানে বেড়াতে গেছেন আর আমরা বাকিরা বাড়িতে। সেলিম বেশ ভালোই কথা বলে। সে মাঝখানে আমার কথার মধ্যে ঢুকে যে ভুল তথ্যগুলো আমি তাদেরকে দিয়েছি, সেগুলো রিপিট করে জোরে জোরে বলতে শুরু করল, মা বলছে সবাই যুদ্ধ করতে গেছে।
পড়লাম বিপদে, বাঙালি রাজাকার মারল এক থাপ্পড় মুখে। সেই সাথে বলতে লাগলো এত অল্প বয়সে মিথ্যা কথা, দাঁড়া মারব গুলি করে। আমি বললাম, না হুজুর ঘরে চলেন দেখবেন বাবার ছবি ঝোলানো আছে, তিনি পুলিশে চাকরি করেন। ঘরে ঢুকে বাবার ছবি দেখে মনে হয় বিশ্বাস করেছিল আমার কথা।
তারপরও সব ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে বাড়িতে আর কেউ নেই? উত্তরে বললাম, মা আছেন কিন্তু মনে হয় পালিয়েছেন আপনাদের ভয়ে। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছিল তারা নিজেরাও ভিতু। কিছুক্ষণ পর চলে গেল বাড়ি থেকে নহাটা হাইস্কুলের উদ্দেশ্যে।
নহাটা মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলাধীন নহাটা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। যেতে পথেই শুরু হলো গুলিগোলা এবং পরে শালারা লাশ হয়ে রয়ে গেল নহাটাতেই। চাচা নজরুল এবং এয়াকুব মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে গুলি করে ঝরঝরে করে দিয়েছিল সেদিনের সেই পাক হানাদার সেনাদের। ঘটনা মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। বিশেষ করে সেদিনের সেই অপারেশনে মরেছে এক পাক অফিসারও।
সকাল হতেই নহাটার অবস্থা যে শোচনীয় হবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। সেদিন রাতেই আমরা গ্রাম ছেড়ে নিজ দেশে শরণার্থী হয়ে গেলাম। পরের দিন যশোর ক্যান্টেনমেন্ট থেকে পাকসেনারা এসে নহাটার বাজারে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পুরো বাজার মাসের পর মাস ধরে পুড়েছে তখন।
দীর্ঘ নয়টি মাস ভবঘুরে হয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম করে কাটিয়েছি। দেখেছি আপনজনদের মৃত্যু, শুনেছি আর্তনাদ, তবুও ভয় কখনও আঁকড়ে ধরতে পারেনি আমাদের।
সকাল সন্ধ্যা কখন কীভাবে কেটেছে, কবে, কোথায়, কখন কী করেছি, কী হয়েছে সব মনে আছে। সব কথা লিখতে গেলে আসল কথা লেখা হবে না। আবার আসল কথা লিখতে গেলে সব কথা লেখা যাবে না। কারণ প্রতিটি কথাই সব কথা, আর প্রতিটি কথাই আসল কথা।
হরতালের কথা, চেতনার কথা, ধর্ষণের কথা, আগুন জ্বালিয়ে পুরো বাজার পুড়িয়ে ছাই করে দেবার কথা, ভাইয়ের মৃত্যুর কথা, বিজয়ের কথা, স্বাধীনতার কথা, গা শিউরে উঠার কথা...সবকিছুই আসল কথা।
আজ একে একে সব কথা স্মৃতির জানালায় চুপি চুপি এসে হাজির হয়েছে। কারণ আমি মনের সব কটা জানালা খুলে দিয়েছি। আমি আজ সেদিনের দূরপরবাসে বসে।
সেই ১৯৭১ সাল থেকে আজ অবধি প্রতি বছরই অপেক্ষা করি এই মাসটির জন্য। অপেক্ষা আর প্রতীক্ষা করতে করতে হঠাৎ ৫২ বছর পার হয়ে গেছে! কী আশ্চর্য মনে হচ্ছে এই তো সেদিন পাক বাহিনীর লোকেরা আমাদের পুড়িয়ে করেছিল ছারখার।
লাখো শহীদের মৃত্যুর অর্জন তুমি আমার বাংলাদেশ। মায়ের হাত ধরে বলেছিলাম কেঁদো না, কেঁদো না। অনেক হারাতে হয়েছে জীবনে তোমাকে পেতে। সেই অপরাধে আমি অপরাধী তাই আজও একলা কাঁদি। তারপরও তুমি আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
এই ভালোবাসা থেকে বিজয়ের এই মাসে শুধু একটিই চাওয়া সেটা হলো সাদাসিধে এক স্বপ্নসাধ, যেখানে থাকবে শুধু—‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ, ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
© দিন পরিবর্তন