logo

উপজেলায় তিন চ্যালেঞ্জে ইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:16 Feb 2024, 03:06 PM

উপজেলায় তিন চ্যালেঞ্জে ইসি


নানা আলোচনা ও প্রতিকূলতার মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এত বড় কর্মযজ্ঞ শেষে এখন বছর জুড়েই চলবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। রাজনৈতিক চাপ, প্রভাবমুক্ত ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসম্পন্ন করাই ইসির জন্য আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দলীয় প্রতীকে প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ উম্মুক্ত হলে, এতে সংঘাত সহিংসতার মাত্রাও বাড়তে পারে। যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ইসির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছে না ইসি। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পেলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সুষ্ঠু নির্বাচনসম্পন্ন করার আশা সাংবিধানিক এই সংস্থাটির।

এদিকে দেশের ছয়টি নির্বাচনী অঞ্চলের ৩৪৪টি উপজেলায় নির্বাচন কোন কোন ধাপে হবে সেই তালিকাও প্রকাশ করেছে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। সব মতাদর্শের প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভোটার সংখ্যা বাড়ানো এবং সংঘাত সহিংসতামুক্ত ভোট আয়োজনে তিন চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে উপজেলা নির্বাচনের পথে এগুচ্ছে ইসি।

এরই মধ্যে ভোটে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। পিছিয়ে নেই সংসদদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও। তবে সরকারের পদত্যাগের দাবিকে মুখ্য করে সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনেও অংশ না নেওয়ার পথে হাঁটছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশকিছু দল। যদিও দলটির পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়ে এখনো অবস্থান পুরোপুরি পরিষ্কার করা হয়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা এড়িয়ে উপজেলা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে পারে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক না দেওয়ার ঘোষণা নির্বাচনকে সার্বজনীন ও উৎসবমুখর করার উদ্যোগকে এক ধাপ এগিয়ে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএনপিসহ অন্য বড়দলগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগের নতুন সিদ্ধান্তে দলীয় প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ উম্মুক্ত হতে পারে। এতে সংঘাত সহিংসতার মাত্রাও বাড়তে পারে।

সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রচারণার আড়ালে একদলীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো সব উপজেলায় নিজ দলীয় চেয়ারম্যান নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক বিহীন নির্বাচনের অপকৌশল এঁটেছে। এই দলই ভোটের ফলাফল প্রভাবিত করতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনী আইন সংশোধনী এনে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকের বিষয়টি যুক্ত করেছিল। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দলটি নির্বাচন কমিশন ও আইনকে যখন যেভাবে সুবিধা সেভাবে ব্যবহার করছে বলেও আভিযোগ তাদের।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। সে হিসাবে এবার মোট ৪৯৫টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। এর মধ্যে ৪৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপযোগী হয়ে আছে। জুনের মধ্যে বাকি উপজেলায় নির্বাচন করতে হবে। সব উপজেলার মেয়াদ একই সময় শেষ না হওয়ায় ধাপে ধাপে ভোট করতে হবে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপের ভোটের সম্ভাব্য তারিখ দেওয়া হয়েছে ৪ মে। এছাড়া ১১ মে দ্বিতীয় ধাপ, ১৮ মে তৃতীয় ধাপ এবং ২৫ মে চতুর্থ ধাপের ভোটের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।

ইসির ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী প্রথম ধাপে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১০৮টি উপজেলায় ভোট হবে। দ্বিতীয় ধাপে ১২১টি, তৃতীয় ধাপে ৭৭টি এবং চতুর্থ ধাপে ৩৮টি উপজেলায় ভোট হবে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজেলাগুলোর তালিকা পরবর্তীতে করা হবে।

নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আলমগীর জানিয়েছেন, মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাচন হবে। এসএসসি পরীক্ষা এবং রমজান মাসের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ঈদের পরপরই নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপিসহ অন্যান্য নিবন্ধিত দল ভোটে অংশ না নিলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনের মতো যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তার পথ খুঁজছে ইসি।

কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অতীতের তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ার পাশপাশি বিশৃঙ্খলাও বাড়তে পারে। আর সে পরিস্থিতি এড়াতে এবার জেলা নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ উপজেলা ধরে ভোটের ধাপ ঠিক করা হবে। তাতে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় ভোটের দিনে জেলার বাকি উপজেলা থেকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের লোকজন কাজ করার সুযোগ পাবে।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হতে যাওয়া এই নির্বাচনে ভোট পরার হার কতটা হবে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলের পাশাপাশি খোদ নির্বাচন কমিশনের ভেতরেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। আর তার সমাধানে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে বিশেষ উদ্যাগ নেওয়ার প্রস্তাবনাও রয়েছে বলে জানা গেছে।

উপজেলা নির্বাচনের অতীত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। ওই বছরের মার্চ থেকে শুরু হয়ে পাঁচ ধাপে ৪৫৫টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শেষ হয়েছিল জুনে। এর মধ্যে মার্চেই চারটি ধাপের ভোট হয়েছিল। ওই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে দলীয় প্রতীকে। ভাইস চেয়াম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানর পদ দুটি উম্মুক্ত ছিল। দলীয় প্রতীকে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি ভোট বর্জন করে।

ইসির দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে ভোটের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। আর ২০১৭ সালের মার্চে প্রথমবার তিন উপজেলায় দলীয় প্রতীকে ভোট হয়।

আইন অনুযায়ী, দুইভাবে মনোনয়ন দেওয়ার নিয়ম আছে। রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন বা স্বতন্ত্র। এক্ষেত্রে যেকোনো দল যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে আইন পরিবর্তনেরও কোনো প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, স্বতন্ত্র হিসেবে উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী যদি আগে এই পদে নির্বাচিত হয়ে না থাকেন তাহলে তাকে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থন রয়েছে এই মর্মে কাগজপত্র জমা দিতে হবে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যেকোনো দল চাইলে প্রতীক নিয়ে এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।’ এই নির্বাচনে সহিংসতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর অবস্থানে রাখা হবে বলে জানান তিনি।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেছেন, সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে ইসিকে নির্দিষ্ট পথে হাঁটতে হবে। কোনো দলের প্রতীক বিহীন আর কোনো দল প্রতীকে প্রার্থী দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ অবস্থার উত্তরণে আইন সংশোধনের বিকল্প নেই।

দলীয় প্রতীকে ভোট না করাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলীয়ভাবে এ নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এ নির্বাচনটি সার্বজনীন করার জন্যই আওয়ামী লীগ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে যার যার মতো করে স্বতন্ত্রভাবে ভোট করবেন নেতারা। আশা করি এতে অংশগ্রহণমূলক আর উৎসবমুখর ভোটে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।’

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না বলে আমরা সংসদ নির্বাচনে যাইনি। স্থানীয় নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ কোথায়। এখন আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সেটা নিয়েই আমরা ভাবছি।

বর্তমান কমিশন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারেনি। স্থানীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারবে না। কারণ তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। অন্যদিকে ভোট একচেটিয়া হওয়াতে ভোটারদেরও আগ্রহ নেই। নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করা ছাড়া সুষ্ঠু ভোটের চিন্তা করা কঠিন।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু তার দলের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যাবে। তবে দলীয় ফোরামে এখনো আলোচনা হয়নি। আমরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করব।’
হিসাব অনুযায়ী, দলীয় প্রতীকে প্রথম বারের মতো ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম ভোট পড়েছে। এ হার ছিল মাত্র ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ।

২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৬৩ দশমিক ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ।

তবে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো ও সংঘাতমুক্ত করা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শতাধিক প্রাণহানির নজির আছে। আবার ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশঙ্কাজনকহারে কমছে। সে কারণে ভোটারদের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান কমিশন সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারেনি। স্থানীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারবে না। কারণ তাদের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। অন্যদিকে ভোট একচেটিয়া হওয়াতে ভোটারদেরও আগ্রহ নেই। নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করা ছাড়া সুষ্ঠু ভোটের চিন্তা করা কঠিন।’

আর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে ভোট হওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কমছে। একদলের প্রার্থীদের প্রভাবে অন্য ভালো প্রার্থীরাও ভোটে অংশ নিতে আগ্রহ দেখান না। এক্ষেত্রে কমিশনকে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভোটার ও প্রার্থীকে অভয় দিতে হবে। অন্যথায় কোনো প্রস্তুতিতেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হবে না।’

DP-ASIF



© দিন পরিবর্তন