নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:19 Jul 2022, 05:34 PM
উসকানির হাতিয়ার ফেসবুক!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে বার বার হাতিয়ার বানাচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী। আর এর শিকার হচ্ছেন দেশের হিন্দু সম্প্রদায়। ফেসবুকে কে বা কারা ধর্মীয় অনুভূতিতে পোস্ট দেয়। আর এটিকেই পুঁজি করে এই গোষ্ঠী হামলা, ভাঙচুর এমনকি অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। নিখুঁত পরিকল্পনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলরা।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ করে গোষ্ঠীটি এলাকাভিত্তিক এ কাজ করছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তবে সামাজিকভাবে সাধারণ মানুষকে প্রতিরোধ করতে হবে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পুলিশ যেতে পারে না। যদি সামাজিকভাবে এ বিষয়ে প্রতিরোধ হয় তবে কোনো পরিকল্পনা সফল হবে না।
সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার নড়াইলের লোহাগড়ায় আকাশ সাহা নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে হজরত মোহাম্মদ (সা) কে অসম্মান করে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। এমন পোস্ট দেখার পরে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের লোকেরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। জুম্মার নামাজের পরে স্থানীয়রা আকাশের বাবা অশোক সাহার মুদি দোকানে গিয়ে ছেলের খোঁজ করে। তাকে না পেয়ে দোকানে ভাঙচুর চালায়। এ সময় বাজারের অন্যান্য দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিকেলের পর আকাশের বাড়ি সাহাপাড়ায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। এক পর্যায়ে তারা সাহাপাড়ার মন্দিরের ভিতরে ঢুকে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।
বিক্ষুব্ধ লোকজন সন্ধ্যার পর সাহাপাড়ার গোবিন্দ সাহা, তরুণ সাহা, দিলীপ সাহা, পলাশ সাহাসহ ৫-৬টি বাড়ি ভাঙচুর করেন এবং গোবিন্দ সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে দুই রুমের টিনের ঘর পুড়ে গেছে। এ সময় পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করছেন, ওই শিক্ষার্থী এরকম ধর্মীয় কোনো পোস্টে মন্তব্য করেনি। এটা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার নাম এবং ছবি দিয়ে করা হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা করেই হয়তো লুটপাট, ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে একই জেলার গত ১৮ জুন নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে রাহুল দেব নামে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র নুপুর দেবকে সমর্থন করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। শিক্ষক স্বপন কুমার ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন এমন অভিযোগ তুলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ অভিযুক্ত ছাত্রকে জুতার মালা পরিয়ে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। এরপর থেকে বাড়ি না ফিরে নিজেকে আড়াল করেছেন অধ্যক্ষ স্বপন কুমার। এ ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
সূত্র জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে যেকোনো সময় অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এমন অবস্থায় ফেসবুক কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের এমন নির্দেশনার পর অন্তত কয়েক হাজার আইডি চিহ্নিত করে পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় এসব আইডি পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হতে পারে। পরিস্থিতি গভীর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মাঝে মাঝে এলাকাভেদে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ফেসবুকে ভুয়া আইডি বানিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো পোস্ট করছে। সেই পোস্টগুলো নিয়ে শুরু হচ্ছে উত্তেজনা। এক পর্যায়ে হামলা, ভাঙচুর, আগুন এমনকি লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। আর প্রতিবারই আক্রান্তের শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
কর্মকর্তারা বলছেন, ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্টের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় গণবিক্ষোভের বিষয়টি নিয়ে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। সে দেশের গণবিক্ষোভের বিভিন্ন ছবি আইডিতে দিয়ে উস্কানিমূলক নানা পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে গণবিক্ষোভের বিষয়টি সামনে এনে অরাজাকতা পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের উস্কানি বা গুজব তৈরি করে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন আইডি থেকে একের পর এক পোস্ট করা হচ্ছে। এমনকি মন্ত্রী এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে কুৎসা রটনামূলক শত শত পোস্ট করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় ওই আইডি ও মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশ ও দেশের বাইরে এ ধরনের কয়েকহাজার আইডি এ কাজে লিপ্ত রয়েছে। আইডিগুলোকে শনাক্ত করে তাদের ওপর পর্যবেক্ষণের মাত্রা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলেও সেখানে মতামত দেওয়া হয়েছে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বরাবর কিছু চিহ্নিত আইডি থেকে সরকারবিরোধী নানা পোস্ট করা হয়। এছাড়াও সমসাময়িক বিষয় নিয়েও উস্কানিমূলক পোস্টও দেওয়া হয় ওই আইডিগুলো থেকে। ওই আইডিগুলোকে চিহ্নিত করে মাঝে মাঝে অপারেশন চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় আইডি পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের।
কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারবিরোধী বা উস্কানি বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে এমন পোস্ট দেখামাত্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট তৎপর রয়েছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অবগত রয়েছি। পরিস্থিতির ওপরও নজর রাখা হয়েছে। কোথাও কোনো ইনসিডিন্টে হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে ব্যাপারেও আমরা কাজ করছি।
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নাজমুল আলম বলেন, গুজব, উস্কানি ও উগ্রবাদীদের অনলাইন কার্যক্রমের বিষয়টি নিয়ে আমরা বরাবরই সতর্ক। আমরা এ ধরনের প্রায় প্রায় হাজারের মতো আইডি চিহ্নিত করে শতাধিকের ওপর আমরা মামলা ও গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, মূলত দেশের বাইরে থেকেই এ ধরনের পোস্ট বেশি হয়ে থাকে। তারপরও পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা সতর্ক রয়েছি। কিছু আইডিগুলোর কার্যক্রম গভীরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কোথাও কোনো ইনসিডিন্টে হওয়া মাত্রই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। নির্দেশনার আলোকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সে ব্যাপারে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
বগুড়া জেলার পুলিশ সুপার সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী জানান, আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক রয়েছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার মতো আশঙ্কা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে নওগাঁর মহাদেবপুরে জাতীয় সংগীত চলাকালে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনী পাল স্কুল ড্রেস পরে না আসায় কয়েকজন ছাত্রীকে মারধর করেন। এ সময় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বদিউল আলম অষ্টম শ্রেণির তিন ছাত্রীকে মারধর করেন। পরে হিজাব পরায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়েছে ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়। এ ঘটনার জেরে বিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে আসবাব ভাঙচুর করে স্থানীয়রা।
ঘটনাটি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গুজব ছড়ানোর অপরাধে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
গুজব ছড়িয়ে হামলার ঘটনা : ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার রামুতে ফেসবুকে একটি ছবি ট্যাগ করা নিয়ে বাধে তুলকালাম কাণ্ড। বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের এক যুবকের ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার জের ধরে রামুতে বৌদ্ধ স্থাপনা ও বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়। দশটিরও বেশি বৌদ্ধ বিহার ও প্রায় ২৫টি বাড়িতে চলে হামলা-ভাঙচুর।
পরের ঘটনা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। রামুর কায়দাতেই ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর আক্রান্ত হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সে সময় অভিযোগ করা হয় রসরাজ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে ইসলাম বিদ্বেষী ছবি প্রকাশ করে। অথচ আড়াই মাস পর জানা যায় রসরাজ ফেসবুকে চালাতে জানেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিরনগরে হামলার এক বছর পর ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়াতে ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জের ধরে এক জনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ সেই একই, হিন্দু তরুণের ফেসবুকে থেকে নবীকে অবমাননার অভিযোগ।
২০১৯ সালে ভোলার বোরহানউদ্দিনে একটি কথিত বক্তব্য দিয়ে তৈরি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ঘটে সহিংস বিক্ষোভ। এই ঘটনায় চারজন নিহত হন। আহত হন ১০ পুলিশসহ প্রায় দেড়শোরও বেশি।
২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার মুরাদনগরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ব্যক্তির ফেসবুকে কমেন্টের জের ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি ঘর, উপাসনালয়ে হামলা এবং ভাঙচুর হয়।
হেফাজত নেতা মামুনুল হককে উদ্দেশ্য করে দেয়া এক হিন্দু ব্যক্তির স্ট্যাটাসের কারণে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় কয়েক হাজার মানুষ। কুমিল্লায় নানুয়ারদীঘি এলাকার একটি পূজামণ্ডপের প্রতিমাকে ঘিরে ধর্মীয় বিতর্কিত ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ড. কুদরাদ ই খুদা বাবু বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি একটি গোষ্ঠী এ ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। সংঘবদ্ধভাবে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষের উত্তেজিত করে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
তিনি বলেন, এ জন্য সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর পদক্ষেপগ্রহণ প্রয়োজন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই কেবল এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।
© দিন পরিবর্তন