logo

উৎকোচ দিয়ে মিলছে পদায়ন-পদোন্নতি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:09 Sep 2022, 07:39 PM

উৎকোচ দিয়ে মিলছে পদায়ন-পদোন্নতি!


নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদায়ন, পদোন্নতি কোনোটাই হচ্ছে না পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে।  বিশেষ তদবিরের প্রভাবে জুনিয়র অনেক অফিসার ডিরেক্টর হয়ে গেলেও অনেক সিনিয়র অফিসার পদোন্নতি না পাবার ব্যথা বুকে চেপেই এলপিআরে যাচ্ছেন।  এই পরিস্থিতিতে  পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে মাঠ পর্যায়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে।  প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা।  ভুক্তভোগীদের দাবি এ পরিস্থিতির আশু উন্নতি হওয়া দরকার।  অন্যথায় মাঠ পর্যায়ে শৃংখলা ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বর্তমান সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদল দায়িত্ব নেবার পর থেকেই এই অধিদপ্তরের পদায়ন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।  অভিযোগ রয়েছে, বিভাগটির ডিরেক্টর এডমিন খান মোহাম্মদ রেজাউল করিম সমস্ত পদায়ন ও পদোন্নতি ‘একহাতে’ নিয়ন্ত্রণ করছেন।  খান মোহাম্মদ রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী কর্মস্থলে অর্থনৈতিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।  এই বিভাগেও তিনি সচিবের ‘ভরসা’র জায়গা হিসেবে পরিচত হওয়ায় পদায়ন, পদোন্নতির কোনো আবেদনই তার ‘আনুকূল্য’ ছাড়া সচিব বরাবর উপস্থাপন হচ্ছে না।  ‘আনুকূল্য’ পেলে আবেদন যায় সচিবের কাছে।  নয়তো ডিজি অফিসেই ফাইল পড়ে থাকে। 

ডিজি অফিসে কর্মরত ভুুক্তভোগী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি  সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।  আমার ব্যাচ অনেক আগের।  কাজেও আমি অভিজ্ঞ। ডিরেক্টর পদের জন্য আমি এলিজেবল।  প্রমোশনের জন্য আবেদন করেছিলাম। হয়নি।  কারণ টাকার দৌড়ে আমি ফেল করেছি।’  

পদোন্নতি বঞ্চিত এই সিনিয়র কর্মকর্তা আরো অভিযোগ করে বলেন, তিনি যখন পদোন্নতির আবেদন করেন তখনই পদায়ন ও পদোন্নতি ‘সিন্ডিকেট’-এর একজন তাকে বলেছিলেন, আবেদন করলেই কি পদোন্নতি হবে ভাই? ‘চেষ্টা’ও তো করতে হবে।

জানা গেছে, জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে জুনিয়র অফিসাররা পদোন্নতি হওয়ায় সৎ, দক্ষ ও যোগ্য সিনিয়র কর্মকর্তারা এখন বেশ অস্বস্তিতে।  কেবলমাত্র ‘বিশেষ’ যোগাযোগ করতে না পারায় তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন।  এতে করে বিভাগের প্রশাসনিক কাজকর্মে একরকম সমন্বয়হীতা দেখা দিয়েছে।  চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে বঞ্চিতদের মাঝে। 

স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সূত্রমতে, গত ২৭ মার্চ ২০২২ এক আদেশে ১৪ পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র স্কেল ৬ষ্ঠ গ্রেডে সহকারী পরিচালক করা হয়।  এই তালিকায় অপেক্ষাকৃত সিনিয়র ব্যাচ ২২তম ব্যাচটি বঞ্চিত হয়েছেন।  এই ব্যাচ থেকে মাত্র ইসতিয়াজ ইউনুস ও জিন্নাত আরার ভাগ্যে পদোন্নতি জুটেছে।  সিংহভাগই এসেছেন অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ব্যাচ ২৭ ও ২৮ তম থেকে।  পদোন্নতি বঞ্চিত একজন নাম প্রকাশ করতে চাননি।  তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যখন ২৭ ও ২৮ তম ব্যাচ থেকে গণহারে সহকারী পরিচালক বানানো হলো তখন ২২তম ব্যাচের একজন পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কি অবস্থা হতে পারে তা একবার ভাবুন।  এটা বিভাগের অভিভাবকদের উপলব্ধিতে থাকতে হবে।  তিনি অভিযোগ করেন, এমনটা হচ্ছে কেবল অর্থের মানদণ্ড পদোন্নতি বিবেচিত হওয়ায়। 

পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের একাদিক সিনিয়র কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, কয়েক বছর আগেও এই বিভাগে পদায়ন, পদোন্নতি-এসব নিয়ম মতোই হয়ে আসছিল।  বিভাগটিতে একটি সিস্টেমে নিয়ে এসেছিলেন সাবেক দায়িত্বশীলরা।  বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি যাকে ডিপিসি বলা হয়।  এই কমিটি বেশ কার্যকর ছিল।  জ্যেষ্ঠতা বা ক্রমানুসার মেনেই বেশিরভাগ পদোন্নতি হতো।  জানা যায়, পূর্বের সচিব আলী নূর-এর পর বর্তমান সচিব দায়িত্ব পাবার পর থেকেই পদোন্নতি, পদায়ন-এসব একটা সিন্ডিকেটের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।  এই সিন্ডিকেটের ‘আনুকূল্যেই’ ১৮তম ব্যাচের শুরুতে থাকা অনেককে ডিঙ্গিয়ে  ব্যাচের ২০তম সিরিয়ালে থাকা আব্দুল লতিফ মোল্লা এবং ২৫তম সিরিয়ালে থাকা মো. নিয়াজুর রহমানকে একটিং ডিরেক্টর হিসেবে পদায়ন করা হয়।  অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে পদায়ন, পদোন্নতিতে।  ফলে জ্যেষ্ঠতা, সৎ, যোগ্য-এসব আর মুখ্য মানদণ্ড হিসেবে টেকেনি।  অভিযোগ রয়েছে, কানাডা বিএনপিতে নিয়াজুর রহমানের স্ত্রীর একটি বড় পদবি রয়েছে।  অথচ নিয়াজুর রহমান নিজেকে বর্তমান সরকারের ‘লোক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিয়াজুর রহমান জানান, তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং নিয়ম মেনেই তাকে পদায়ন করা হয়েছে।  কানাডা বিএনপিতে স্ত্রীর পদবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। 

পদোন্নতি বঞ্চিত অন্য আরেকজন নাম প্রকাশ না করা শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন,  মেধাক্রম অনুসারে যারা সিরিয়ালে আগে বা জ্যেষ্ঠ, নিয়ম অনুযায়ী তাদেরই পদোন্নতি, পদায়ন আগে হবার কথা।  এতে অফিসিয়াল শৃংখলা ঠিক থাকে।  কিন্তু এর থেকে অস্বাভাবিক বা ব্যতিক্রম কিছু যখন হয় তখনই শৃংখলা নিয়ে প্রশ্ন আসে, কষ্ট লাগে।  শীর্ষ কর্তৃপক্ষের এই বিষয়গুলো বোঝা দরকার।  তিনি প্রশ্ন করে বলেন, একজন অনেক সিনিয়র।  পুরনো ব্যাচ। ডিডি হিসেবে দায়িত্ব খুব দক্ষতার সাথেই পালন করছেন।  তাকে ডিরেক্টর হিসেবে পদাযন করা হলো না।  অথচ তাদের জুনিয়র ব্যাচ থেকে হুট করে ডিরেক্টর হিসেবে পদায়ন করা হলো।  তখন অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? তিনি বলেন, এ কারণে নীরবে নিভৃতে অনেকেই এলপিআর এ চলে যাচ্ছেন। 

একটি সূত্র জানায়, আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ডিপিসি নিয়েও এই চক্রটি কৌশল এঁটেছে।  কারণ ডিরেক্টর হবার জন্য পুরনো একটি ব্যাচ এলিজেবল।  অধিদপ্তরে ৭জন, আটটি বিভাগীয় অফিসে ৮জন এবং ২জন টেকনিক্যাল পরিচালক যারা চিকিৎসক-এই মোট ১৫টি পরিচালক পদের বিপরীতে ৪র্থ গ্রেড বেতন স্কেলে পদোন্নতি হবার কথা রয়েছে।  এছাড়াও ১টি শূন্য পদের বিপরীতেও পরিচালক নিয়োগ হবে।  জানা গেছে, এই পদগুলোর সবকটিতে ভারপ্রাপ্ত বা সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে।  কেউ কেউ আবার একাই ২টি বিভাগীয় অফিস ডিরেক্টর হিসেবে ‘সামলাচ্ছেন’।  সূত্রটি জানায়, যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি দিতে হয় তবে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র ব্যাচ থেকে আবেদন বেশি জামা হবে।  কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, ডিরেক্টর হিসেবে সিন্ডিকেটের পছন্দের প্রার্থীদেরকেই অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান বা সংযুক্তি দিয়ে রাখা হয়েছে।  যাতে কোনো পদ শূন্য না দেখায়।  এটা এই সিন্ডিকেটের একটা কুটকৌশল।  কারণ তারা ডিরেক্টরের সুবিধা ভোগ করছেন।  আসছে ডিসেম্বরে যদি ডিরেক্টর পদে পদোন্নতি দিতে হয় তবে যাদেরকে সংযুক্ত করা আছে বা অতিরিক্ত দায়িত্বে রাখা হয়েছে তাদেরকে সরাতে হবে।  সূত্রটি জানায়, যেটা বর্তমান নিয়ন্ত্রকরা করতে চাইছেন না।  তারা বলার চেষ্টা করছেন কোনো পদই তো শূন্য নেই। 

এই কুটকৌশলের আশ্রয় নেওয়ায় যারা পদোন্নতি পাবেন বলে এতোদিন আশা করে ছিলেন তারা রীতিমতো হতাশ।  তারা চাচ্ছেন আগের মতো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদোন্নতি দিয়ে যোগ্যতা দক্ষতাকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনায় রাখা হোক।  

এদিকে কয়েকজন সিনিয়র অফিসার নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে এভাবে নিচ থেকে তুলে এনে পদন্নতি দেওয়া হলে এই বিভাগে শৃঙ্খলা বলে কিছু আর থাকবে না।  এমনিতেই সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে।  আরো ভেঙে পড়বে।  তারা আশা করেন, বিভাগের অভিভাবকরা অন্তত এই বিষয়টি আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। 

এদিকে এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের বর্তমান সচিব মো. সাইফুল হাসান বাদলের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। 



© দিন পরিবর্তন