logo

এবার বিদেশি ঋণে হোঁচট

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:24 Sep 2022, 04:57 PM

এবার বিদেশি ঋণে হোঁচট


সম্প্রতি বিদেশি ঋণপ্রবাহ কমেছে।  চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।  এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম।  কারণ গত অর্থবছরের এই দুই মাসে ১১৪ কোটি ২৯ লাখ (১.১৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা। 

গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর।  নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণসহায়তা এসেছিল।  গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে বেশি এসেছিল ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খেয়েছে।  এই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে দাতারা।  যা আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম। 

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরে কম সুদের বিদেশি ঋণ প্রাপ্তিতে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ।  ওই অর্থবছরে ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।  বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক অর্থবছরে এত বেশি ঋণসহায়তা পায়নি বাংলাদেশ। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বিদেশি ঋণ ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) দাতাদের কাছ থেকে যে ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য এসেছে ৮৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার।  আর অনুদান পাওয়া গেছে ৩ কোটি ১৪ লাখ ডলার। 

গত বছরের একই সময়ে প্রকল্প সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল ১১০ কোটি ৮৭ লাখ (১.১০ বিলিয়ন) ডলার। অনুদান এসেছিল ৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার।  ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। 

তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার।  বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে।  ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।  তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার। 

 

শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে।  যদিও দুই দেশের তুলনা নাকচ করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা।   তারা বলছেন, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। 

হঠাৎ করে বিদেশি ঋণ কমার কারণ ব্যাখ্যা করে অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গিয়েছিল।  কিন্তু এখন তো আর কোভিডের ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না।  অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে অন্যরাও আগের চেয়ে কম ঋণ নিচ্ছে।  সে কারণেই বিদেশি ঋণ কমছে।  আমার মনে হচ্ছে, এবার গতবারের চেয়ে ঋণ বেশ খানিকটা কম আসবে। 

তিনি বলেন, এই কঠিন সময়ে আমাদের দেখেশুনে ঋণ নিতে হবে।  কম সুদের ঋণ ছাড়া অন্য ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।  কেননা, আমাদের বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।  চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই ঋণ তো আমরা প্রতি ডলার ৮৪/৮৫ টাকা হিসাবে পেয়েছি।  এখন ডলারের দর ১০৮ টাকা ১১০ টাকা। ডলারের বাজার যদি স্বাভাবিক না হয়, দাম যদি না কমে, তাহলে আমাদের ঋণের বোঝা কিন্তু অনেক বেড়ে যাবে। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে জাপান, ৩২ কোটি ৯১ লাখ ডলার।  চীনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার।  এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি দিয়েছে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।  বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৯ কোটি ৪১ লাখ ডলার।  ভারত দিয়েছে ৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার। 

এছাড়া রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৪১ লাখ ১০ হাজার ডলার।  এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) দিয়েছে ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। 

ইআরডির তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট সময়ে দাতাদের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি বেড়েছে।  ২০২১-২২ অর্থবছরের এই দুই মাসে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ২২ হাজার ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা।  এই বছরের জুলাই-আগস্টে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৩০ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ডলার।  এ হিসাবে প্রতিশ্রুতি তিনগুণ বেড়েছে। 

 

এদিকে, জুলাই-আগস্ট সময়ে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।  গত বছরের একই সময়ে সুদ-আসল বাবদ ২৯ কোটি ৮২ লাখ ২০ হাজার ডলার শোধ করা হয়েছিল।  এ হিসাবে এই দুই মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ প্রায় ৩ শতাংশ বেশি অর্থ শোধ করতে হয়েছে সরকারকে।  বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে আড়াই লাখ কোটি টাকা 

আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বুধবার টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা।  অর্থাৎ ১ ডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১০৭ টাকা ৬৫ পয়সা।  এক বছর আগে ২১ সেপ্টেম্বর টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ২৭ পয়সা। 

ডলারের বিপরীতে টাকার বিশাল এই পতন দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- জানতে চাইলে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ডলারের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আমাদের।  আমদানি কমছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ছে।  কিন্তু ডরারের দর কমছে না; এরই মধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। 

তিনি বলেন, আমি হিসাব করে দেখেছি, আমাদের বিদেশি ঋণের বোঝা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে।  আমাদের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলার।  এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলিয়ন) ডলার।  আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২৫ বিলিয়ন ডলার।  এক বছর আগে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪/৮৫ টাকা।  সে হিসাবে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার অঙ্ক ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।  আর বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের রেট ১১০ টাকা দরে যদি আমি হিসাব করি তাহলে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। 

তার মতে, এই সহজ-সরল হিসাব কষেই আমি দেখতে পাচ্ছি, টাকার পতনে এক বছরে আমাদের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়েছে।  এর মধ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।  আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।  এ পরিস্থিতিতে এখন আমাদের টাকার মান বাড়াতেই হবে; যে করেই হোক করতেই হবে।  তা না হলে সংকট আরও বাড়বে। 



© দিন পরিবর্তন