logo

ঐতিহ্য হারাচ্ছে হাওরের চ্যাপা শুটকি

নিজস্ব প্রতিনিধি

Published:09 Mar 2024, 03:35 PM

ঐতিহ্য হারাচ্ছে হাওরের চ্যাপা শুটকি


জাহিদ হাসান, নেত্রকোণা :
হাওরের বাসিন্দাদের রসনা বিলাসে চ্যাপা শুটকির জুড়ি নেই। তবে এখন আর এর খ্যাতি শুধু গহিন হাওরে সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ প্রক্রিয়াজাত এ শুটকির কদর বাড়ছে নগরেও। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেলের রন্ধন শালাতেও স্থান পাচ্ছে চ্যাপা শুটকির ভর্তা। এমন কি যাচ্ছে বিদেশেও। কিন্তু এত কিছুর পরও ভালো নেই চ্যাপা শুটকির প্রস্তুত কারকরা। পর্যাপ্ত পুঁটি মাছের অভাব আর পুঁজি ও বিপনন ব্যবস্থার সঙ্কটে পড়ে পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

মিঠা পানির মাছের সব চেয়ে বড় আধার হচ্ছে হাওরাঞ্চল। নেত্রকোনা জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, কলমাকান্দা, আটপাড়া ও বারহাট্টার হাওর এলাকার জলা ভূমিতে এক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পুঁটি মাছ পাওয়া যেতো। দৈনিন্দিন খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশা-পাশি কাঁচা পুটি মাছ রোদে শুকিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করণের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু চ্যাপা শুটকি, যার আরেক আঞ্চলিক নাম হচ্ছে হিদল। জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই কোনোনা কোনো গ্রামে গড়ে ওঠে ছিল চ্যাপা শুটকির পল্লী। মূলত পেশা হিসেবেই তারা বেছে নিয়ে ছিলেন এ শিল্পটিকে। কিন্তু নানা সঙ্কটে পড়ে ইতিমধ্যে অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এরপরও বারহাট্টা উপজেলার সিংধা,আটপাড়া উপজেলার গুয়াতলা, হাতিয়র, সোনাজোড়, রামসিদ,স্বরমুশিয়া,মদন উপজেলার ফচিকা, মোহনগগেঞ্জের আলোকদিয়া,সদর উপজেলার শিবপ্রসাদপুরসহ জেলার ৩০-৩৫টি গ্রামের জেলে সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। কোনো ধরনের রাসায়নিক উপকরন ছাড়াই তারা বছরে তৈরি করছেন প্রায় ৩শ’ মেট্রিক টন চ্যাপা শুটকি। আর এর বিক্রয় মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।


আটপাড়া উপজেলার গোয়াতলা গ্রামের সর্গীয় যাত্রা বর্মন পুত্র রানা বর্মন’র সাথে কথা হলে দিনপরিবর্তনকে জানান, বাপ-দাদার আমল আমরা এই পেশা চালিয়ে আসছি। এক মন চ্যাপা শুটকি (শিদল) পাইকারি বিক্রি করে ব্যয় বাদে কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। আমি বছরে কমপক্ষে প্রতি মন ৮ আট হাজার টাকা হারে ২ হাজার মণ কাঁচা মাছ ৪ লক্ষ টাকায় ক্রয় করি। এই পরিমাণ কাঁচা মাছ কেটে পরিস্কার করে রোদে শুকিয়ে শুটকি হয় ৫ শত মণ। ওই পরিমান শুটকি বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করে চ্যাপা শুটকিতে পরিণত করলে তা পরিমাণে দাঁড়ায় ৫পাঁচ শত ৬৫মণ চ্যাপা শুটকি। যার বাজার মূল্য হয় ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা ।

এক মণ শুটকি বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করে চ্যাপা শুটকিতে পরিণত করলে তা পরিমাণে দাঁড়ায় এক মণ পাঁচ কেজি। প্রতি কেজির পাইকারি দাম এক হাজার টাকা হারে এই পরিমাণ চ্যাপা শুটকির দাম পাওয়া যায় ৪৫ হাজার টাকা। আর তাতে লাভ হয় ১৩ হাজার টাকা। যদিও খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয় আরও বেশি দামে। রানা বর্মন বলেন, এ পেশায় থেকে ৭ কাটা জমি ক্রয়/ কিনে বিল্ডিং ,বাড়ি-ঘর করেছি । পড়া-শুনা করাছি সন্তানদের। পাশাপাশি ব্যবসার পুঁজির যোগান দিয়ে আসছি। উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি বছর ৩০ কোটি টাকার চ্যাপা শুটকি বিক্রি করে আয় হয় প্রায় ৯ কোটি টাকা। কিন্তু হাওরে পুঁটি মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং পুঁজির ঘাটতি থাকায় এই লভ্যাংশের পুরোটা পাচ্ছেন না উৎপাদনকারীরা। কারণ তাদের পুঁজির জন্য ছুটতে হয় স্থানীয় মহাজনদের কাছে। আনতে হয় চড়া সুদের ঋণ। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতাদের পাশে ব্যাংক গুলো এখনও এসে দাঁড়ায়নি।

এ ব্যাপারে আটপাড়ার গোয়াতলা গ্রামের মৃত কৃঞ্চ বর্মনের পুত্র চ্যাপা শিল্প উৎপাদনকারী সুনীল চন্দ্র বর্মন ও বানিয়াজান গ্রামের রমেশ চন্দ্র দাস পুত্র রতন চন্দ্র দাস’র সঙ্গে কথা বললে তিনি দিন পরিবর্তনকে বলেন, পুঁটি মাছের বদলে বাজারে এখন সামুদ্রিক মাছের তৈরি চ্যাপা বিক্রি হচ্ছে। স্বাদে ও মানে ততোটা ভালো না হলেও দাম কম হওয়ার কারণে সেদিকেই ঝুঁকছে মানুষ। কিন্তু পুঁজির সঙ্কট দূর করার পাশা-পাশি বিপনন ব্যবস্থার উন্নতি হলে চ্যাপা শুটকি বিদেশেও রপ্তানী করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন উৎপাদনকারী তৈরি করা সম্ভব বলেও জানিয়েছেন তারা।

একই গ্রামের মৃত সুরেন্দ্র চন্দ্র বর্মন’র পুত্র স্বপন চন্দ্র বর্মন (৪৫) বলেন,বাপ-দার্দাও এই শিল্পের সাথে জড়িত থেকে জীবন কাটিয়ে গেছেন। আমরা করছি, আমাদের সন্তানরা করবে। এ পেশা আমাদের জাতীয় পেশ্ া। সিজেনে ৪/৫শ’ মণ কাঁচা মাছ কিনি। শুকাই চ্যাপা শুটকি তৈরী করে খুচরা বিক্রির ব্যবসা চালাই। খুচরা বিক্রিতে প্রতি কেজি ১৪ শ’/ ১৫শত টাকা বিক্রি করা যায়। নিজের পঁজি নাই। মহাজনদের কাছ থেকে সুদে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছি। সরকার যদি কম সুদে টাকা দিত তাহলে ভালভাবে ছেলে মেয়ে- সন্তান সন্তুতি নিয়ে চলতে পারতাম, আরো ভালভাবে। কি করবো আমাদের তো আর কোণো পেশা নাই। থাকলেও বাপ-দাদাদের ওইতিয্য ছাড়তে পারছি না।

শাহজাহান কবীর, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, নেত্রকোনা বলেন, চ্যাপা শুটকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জীবন মান উন্নয়নে এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন জেলার এই মৎস্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন তাদের ঋণের আওতায় আনা হবে।
চ্যাপা শুটকি তৈরির এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িতদের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর বাড়াতে হবে। পুঁজির সঙ্কট মোকাবেলাসহ পরিবর্তন আনতে হবে বিপনন ব্যবস্থায়। দিতে হবে প্রশিক্ষণ। পাশা-পাশি বাড়াতে হবে পুঁটি মাছের উৎপাদন।

 

 



© দিন পরিবর্তন