logo

কুষ্টিয়ায় তিন দিনব্যাপী লোকজ ঐতিহ্য মেলা শুরু

নিজস্ব প্রতিনিধি

Published:10 Feb 2024, 03:25 PM

কুষ্টিয়ায় তিন দিনব্যাপী লোকজ ঐতিহ্য মেলা শুরু


নুরুন্নাহার সীমা, কুষ্টিয়া :
কুষ্টিয়ায় তিন দিনব্যাপী ওস্তাদ ভাই লাঠি খেলা ও লোকজ ঐতিহ্য মেলা শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে র‌্যালি, আলোচনা সভা, লাঠি খেলা ও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সকল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পূর্তি উপলক্ষে প্রথম দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার(৮ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১২ টার সময় কুষ্টিয়া টাউন হল(বানী হল) থেকে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর আয়োজনে ঐতিহ্যের ৯০ বছর পূর্তিতে এক র‌্যালি বের করা হয়।

র‌্যালিটি শহরের এনএস রোডসহ বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিন করে। এতে অংশ গ্রহন করেন কুষ্টিয়া শহর আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মানজিয়ার রহমান চঞ্চল, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামান ডাবলু, লাঠিখেলা ও লোকজ উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি, বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মিজানুর রহমান সমিন, মুঈদ রহমান, আব্দুল্লাহ আল হাসান রাজু, ডাঃ শাহানা আক্তার চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী নিশান, বিশ্বজিৎ সাহা সন্টু, ফারাদুল আলম চৌধুরী, আলাউদ্দিন আলাল,মীর জাহিদ, জিয়া হাসান চৌধুরী রিপন। পরে বিকেল ৩টার সময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে লাঠি খেলা প্রদর্শন এবং আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করে এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন, লাঠিখেলা ও লোকজ উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক সাইফুল আলম চৌধুরী রিংকি।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শিশির কুমার রায়। আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারন সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু, উপদেষ্টা সদস্য জিয়া হাসান চৌধুরী রিপন, এস এম কাদেরী শাকিল, মোহাম্মদ আলী নিশান, সুব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ। পরে শুরু হয় লাঠি খেলা। খেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ২৮টি দল অংশ গ্রহন করে তাদের লাঠি খেলার কসরত দেখান।

মনজুরীন সাবরিন চৌধুরী রুপন্তী, ওস্তাদ আবুল কাশেমসহ অনেক ওস্তাদ তাদেও সঙ্গীদেও নিয়ে কসরত প্রদর্শন করেন। হাজার হাজার দর্শক তা উপভোগ করেন। অপরদিকে খেলার এ মাঠেই বসানো হয়েছে মেলা। সেখানে পসরা সাজিয়ে বসেছে বিভিন্ন দোকানীরা। যতদূর জানা যায়, কুষ্টিয়ায় প্রায় প্রতি বছর আয়োজন হয়ে আসছে এই লাঠিখেলা। গ্রাম বাংলার এই খেলার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কুষ্টিয়ার স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব প্রয়াত সিরাজুল হক। যিনি চৌধুরী ওস্তাদ ভাই নামে পরিচিত। ৩০ বছর পূর্বে ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন এই ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা।

উত্তরাধিকার হিসাবে এই লাঠিখেলার দায়িত্ব ও লাঠিখেলার ঐতিহ্য রক্ষায় সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল হক চৌধুরী রতন। তার নেতৃত্বে ১৯৯৩সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হয়েছিল ৮শত লাঠিয়ালের অংশগ্রহণে লাঠিখেলা। যেখানে প্রায় ১০০ মহিলা লাঠিয়াল অংশগ্রহণ করেছিল। এই আয়োজনেপ্র্রয়াত মেজর জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৯৭ সালে রতন চৌধুরীর নেতৃত্বে কলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর ৭০ জনের দল লাঠিখেলা প্রদর্শন করেছিল। নজু ভাই এর উৎসাহ ও উদ্যোগের কথা স্মরণীয়। সুলতান মেলা নড়াইল তাঁর নেতৃত্বে লাঠিখেলা প্রদর্শিত হয়েছে। লাখে একটা" ও "আধিয়ার" সিনেমায় লাঠিখেলার দৃশ্য পরিচালনা করেন রতন চৌধুরী। ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লাঠিখেলার এই আয়োজন অব্যহত ছিল।

তাঁর অকাল প্রয়াণে লাঠিয়াল বাহিনী অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। ১৯৩৩ সালে প্রয়াত সিরাজুল হক চৌধুরী এই কুষ্টিয়ায় গড়ে তুলেছিলেন বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অংশ এই লাঠিখেলাকে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলার এই গ্রাম্য খেলা একদিন এই দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশেও প্রদর্শিত হবে। এ দেশে যেমন বিদেশী খেলা জুতো, কুংফ, ক্যারাটে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় প্রতিষ্ঠা ভাল করেছে। এই লাঠিখেলাও একদিন এখানে প্রতিষ্ঠা পাবে। আমেরিকা ও কানাডার বাঙ্গালী কমিউনিটির অনুষ্ঠানে লাঠিখেলা প্রদর্শন একটা বিশেষ আয়োজনের অংশ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গ্রাম বাংলার এই জনপ্রিয় খেলাকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আদিম যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের যুদ্ধ অস্ত্রও আজ অলিম্পিক খেলার ইভেন্ট হিসাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। যেমন বর্শা নিক্ষেপ, চাতকী নিক্ষেপ, হেমারগ্র্র. তীর ধনুক, মল্লযুদ্ধ, বক্সিং, তরবারী, আত্মীয় অস্ত্রও খেলার ইভেন্ট হিসাবে প্রতিযোগিতায় আনা হয়েছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিনে লক্ষ মানুষ সমবেত হয়েছিল বাংলার এই বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান স্বাধীনতা-স্বাধিকার আন্দোলনে এই বাঁশের লাঠির ব্যবহার হয়েছিল। শক্তি ও ক্ষমতা ব্যক্তি স্বার্থ অথবা সামাজিক স্বার্থের প্রয়োজনে ব্যবহার হয়ে থাকে। দুর্বত্তরা তাদের অবৈধ অন্যায় কর্মকন্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। সমাজের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলোকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। অর্জন করতে হয় শক্তি সামর্থ্য। ওস্তাদ ভাই তাই বলেছিলেন- 'সুস্থ সবল দেহের মাঝে উৎকৃষ্ট মন বাস করে'।

ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা অপরিহার্য। কবির ভাষায় 'শক্তি বিহীন মায়ের ছেলে সকল কাজে যাই যে হেরে'। গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়-উপজেলায় নবান্ন উৎসবে, আশুরাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রদর্শন হয়েথাকে। সাধারণতঃ এলাকার সংস্কৃতিমনা মানুষেরা এই আয়োজন করে থাকে। বর্তমানে খেলাধুলাকে নির্মল আনন্দের বিষয় হিসাবে দেখা হচ্ছে না। এখন খেলাধুলা আচার অনুষ্ঠান পণ্য হিসাবে গণ্য হচ্ছে। মুনাফা থাকলে সেখানে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে সমাজ মননে গড়ে উঠছে পণ্য মানুসিকতা। এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন এই পণ্য মানুসিকতার বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনা গড়ে তোলার। সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই ঐতিহ্য রক্ষা পেতে পারে। না হলে কালের আবর্তে হারিয়ে যাগ্রেগ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্য লাঠিখেলা।

বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন তাজু বলেন, বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী দীর্ঘ ৯০ বছর যাবত এই গ্রামবাংলার লোকজ ঐতিহ্য রক্ষায় লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য ও শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পরিচালনা করে আসছে। সরকারের প্রতি আহবান জানাতে চাই এই লোকজ ঐতিহ্য লাঠিখেলা সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার মাস। পাকিস্তানীরা এ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসে উন্মত্ততায় মেতেছিল যখন, তখন এ দেশের মানুষ জীবন দিয়ে সেই ঐতিহ্য রক্ষায় গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ। ভাষার জন্য আত্মহুতি দিয়েছিল এ দেশের দামাল ছেলেরা। বাংলা ভাষ্য এখন আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

এই ভাষা ও সংস্কৃতির মাসে আয়োজন করেছি ওস্তাদ ভাই লাঠিখেলা উৎসব ও লোকজ মেলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উপস্থিত থাকছেন লাঠিয়াল দল এবং খেলোয়াড় বৃন্দ। লাঠিখেলা প্রদর্শন করছেন শহরের বিভিন্ন জায়গায়। আশা করি সকলের সহযোগিতায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা হয়ে উঠবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যবাহী খেলা।

 



© দিন পরিবর্তন