নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:11 Feb 2024, 02:12 PM
গরিবের এখন অন্নবল নেই
বড় লোকের খাদ্য আছে, খিদে নেই; গরিবের খিদে আছে, খাদ্য নেই। এমন পরিস্থিতি যেন দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের। গরিবের এখন অন্নবল নেই। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বেড়েছে। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেই। এখনো বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। অনেক আগেই মাছ-মাংসের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। এরমধ্যে কখনো ডিমের দাম বাড়ে। আবার কখনো পেঁয়াজ, আলুর দাম বাড়ে। বাজারে শীতকালীন শাক-সবজি ভরপুর থাকলেও দাম এখনো বেশি।
এদিকে সার্বিক পরিস্থিতিতে গত ১৫ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। ভোক্তাদের ওপর চাপ কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের ব্যবস্থা নিতে বলেন। এজন্য ২১ জানুয়ারি, অর্থ, কৃষি, খাদ্য ও মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুত নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে একটি বৈঠক করেন। এতেও বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসেনি। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতি কমে আসলেও এ দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কাও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে, যা বাংলাদেশ পারেনি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এই পতন শিশুর খাদ্য এবং মাংসের দাম হ্রাসের জন্য দায়ী করা হয়েছে। গত তিন বছরে পর্যবেক্ষণ করা সর্বনিম্ন মূল্য চিহ্নিত করেছে গম, ভুট্টা ও তেলের দামও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এই পতনের কারণ হলো- পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত যা ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা, বিশ্বের দুই শীর্ষ উৎপাদক, এই বছর পেয়েছে, যা উভয় দেশে সয়াবিন চাষকে ত্বরান্বিত করেছে।
তবে বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশের পাইকারি বাজারে দামের ন্যূনতম দাম কমলেও এই হ্রাস খুচরা পর্যায়ে কোনো লক্ষণীয় প্রভাব সৃষ্টি করেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল ও গমের দাম ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে আসলেও বাংলাদেশে আটার দাম আগের মতোই রয়েছে।
অন্যদিকে ডলার সংকট ও লোহিত সাগর সংঘাতের মধ্যে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, খাদ্যের দাম শিগগিরই কমার সম্ভাবনা নেই। দেশের খাদ্য বাজার উচ্চ আমদানি খরচ থেকে জটিল ডকুমেন্টেশন পদ্ধতি পর্যন্ত অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বেসরকারি আমদানিকারকরা খাদ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য ডলারের উচ্চ মূল্য, মালবাহী শুল্ক এবং ক্রেডিট লেটার (এলসি) খোলার জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেন। কারণ ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য ডলার কিনতে ১২৪ টাকা দিচ্ছে এবং ১২০% অগ্রিম অর্থ প্রদান না করে ব্যাংকে এলসি খোলা যাবে না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারিতে আটা ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্যাকেজ করা আটার দাম গত মাসে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে, যখন প্যাকেট করা আটার দাম ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিশোধিত বা সর্ব-উদ্দেশ্যহীন আটার দাম ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্যাকেজ করা ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে বাজারে এক কেজি আটার প্যাকেটের দাম ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত, ময়দার এক কেজি একটি প্যাকেটের দাম ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। তাছাড়া, বাংলাদেশের বার্ষিক গমের চাহিদা প্রায় ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যার ৮৫% পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গমের দাম গত বছরের অক্টোবরে প্রতি টন ২৬৬ ইউএস ডলার ছিল, যা ২০২২ সালে ৩৭৮ ইউএস ডলার থেকে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে ৪০০ ইউএস ডলারে। বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে চালের চাহিদার সিংহভাগ মেটাতে পারলেও গমের চাহিদা মেটাতে মূলত বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভর করতে হয়।
উপরন্তু, ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি দখল দারিত্বের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাগরে ইয়েমেনি বিদ্রোহীগোষ্ঠী হুথি হামলার কারণে, আমদানি-বোঝাই জাহাজের জন্য প্রতি কনটেইনার চার্জ ইতোমধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ ইউএস ডলার বেড়েছে।
মোলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম কমার কারণে এখানে লাভ নেই বাংলাদেশ। তবে, এটি অদূর ভবিষ্যতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, পণ্যের দাম কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ লাভবান নাও হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে মধ্যস্বত্বভোগীরা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে, এজন্য মনিটরিং এবং বাজার ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। এ অর্থনীতিবিদ বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমতে অন্তত ছয়মাস সময় লাগবে। এই খরচ কমাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ডিজেলের দাম কমাতে হবে।
এদিকে বিদায়ী বছরে শেষে দিকে গ্রামাঞ্চলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, যা জাতীয় গড় ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। বিপরীতে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত মানুষকে খাদ্য পণ্যের জন্য বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ মাসের মধ্যে ৩১ মাস দেশের গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি শহর ও উপশহর অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল।
গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ খাদ্যমূল্য। যদিও বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামে বাস করেন এবং এসব গ্রাম থেকেই দেশের চাল, শাক-সবজি, মাছ ও হাঁস-মুরগির বেশিরভাগ সরবরাহ আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল ভূমিকা, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মূল্য কারসাজির প্রবণতা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকিতে ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর জায়েদ বখত বলেন : আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দামের প্রভাব প্রতিফলিত হতে কিছুটা সময় লাগে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আমদানি আগের চেয়ে বেশি বলে যুক্তি দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কম দামের পণ্য আমদানি না হওয়া পর্যন্ত তারা দাম কমায় না এবং আগের দামে পণ্য বিক্রি করে। কম দাম আনলেও তারা বেশি লাভের জন্য পণ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক সচিব গোলাম রহমান বলেন, শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশে খাবারের দাম কমছে না। মুদ্রানীতি এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ছিল না। মূল্যস্ফীতি কমাতে এখন বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তাই সহসা পণ্যের দাম ধীরে ধীরে কমবে বলে আশা করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছরে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা তেমন একটা কাজে আসেনি। এ ছাড়া আগামী কয়েক মাস রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় আগামী দুই-তিন মাস মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা কম। এতে গরিব মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।
দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গত বছর ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে একটি এলসি খোলার জন্য ১২০-১২৫% নগদ মার্জিন প্রয়োজন, এবং ক্রমবর্ধমান মালবাহী চার্জের কারণে লোহিত সাগরের সংকট পণ্যের দামকে আরও প্রভাবিত করে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানা জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। রমজান মাসের চাহিদা বিবেচনায় ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকার বাজার ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতোমধ্যে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু হয়েছে, যা পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করবে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
© দিন পরিবর্তন