logo

চমক ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:03 Jan 2024, 06:53 PM

চমক ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ


রেজাউল করিম হীরা:

বিগত সরকারের ১৫ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বদলে গেছে দেশ। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সারা বিশ্বের নিকট রোল মডেল হয়ে গেছে। তবে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রিজার্ভ সংকটে রয়েছে দেশ।

রিজার্ভের এ সংকটের মধ্যে চলতি বছরেই দ্বাদশ সরকারকে মোকবিলা করতে হবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি নিশ্চিত সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের চাহিদা নিশ্চিত করা। সার্বিক পরিস্তিতিতে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলতি বছরে চালিয়ে নেয়াই আগামী সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, দোহাজারী-ঘুমধুম রেল প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেলসহ একের পর এক মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। অবকাঠামো খাতের এসব মেগাপ্রকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে যখন দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, সে সময় চাপের মধ্যে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আর রিজার্ভ চাপে থাকায় দেশের উন্নয়নের চিত্রও যেন কিছুটা চলে যাচ্ছে দৃশ্যপটের বাইরে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে তা মেগা প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে অনেকটাই দৃশ্যমান। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য খুবই দরকার ছিল। তবে নানা কারণে এসব প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি হয়েছে। ব্যয় কমানো গেলে এসব প্রকল্পের রিটার্ন অনেক ভালো পাওয়া যেত।

তারা বলছেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে যখন দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান হচ্ছে, সে সময়ে বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে দেখা যাচ্ছে। ফলে রিজার্ভের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই চাপ সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব রয়েছে। নির্বাচনের আগে রিজার্ভের ওপর থেকে চাপ কমার সম্ভাবনা কম। আর রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় সরকার যে উন্নয়ন করেছে তা কিছুটা হলেও আড়াল হয়ে যাচ্ছে।

দেশের অবকাঠামো খাতের বড় উন্নয়নের মধ্যে সবার ওপর পদ্মা সেতু। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাস্তবে রূপ নিয়েছে গর্বের এ সেতুটি। রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া এ সেতুটি অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি নেওয়া হয়। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কয়েক দফা ব্যয় বাড়ানোর পর সবশেষ বিশেষ সংশোধনী নামে আরেক দফা ব্যয় বাড়ালে তা ৩০ হাজার ১৯৩ কোটিতে উন্নীত হয়। গত ২ জুন আবার পদ্মা সেতুর ব্যয় আবার বাড়ানো হয়।

এর আগে ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ বাতিল করলে একই বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালের ১৭ জুন মূল সেতু নির্মাণ কাজের জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর কাজ উদ্বোধন করেন। গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।

আগে রাজধানী থেকে সড়কপথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে জেলায় যেতে ৮-৯ ঘণ্টা সময় লাগতো, পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল চালুর পর সেখানে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় চলে যাওয়া যাচ্ছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেওয়া আরেক প্রকল্প মেট্রোরেল। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। মেট্রোরেলের কল্যাণে এই ধীরগতির শহরেই এখন খুব অল্প সময়ে কয়েকটি স্থানে যাতায়াত করা যাচ্ছে। মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিলে আসতে সময় লাগছে মাত্র আধাঘণ্টা। রাজধানী ঢাকার বুকে মেট্রোরেল চলাচল করবে, একটা সময় বিষয়টি কল্পনাও করতে পারেনি দেশের বেশিরভাগ মানুষ।

২০১১ সালের নভেম্বরে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্বাক্ষরিত সহযোগিতা চুক্তি (আইজিএ) এবং প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ক্রেডিট চুক্তির ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ স্থাপন কেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। দুই পর্যায় মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে হবে। প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। দুই ইউনিটের এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-কক্সবাজার মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার। শুরুতেই এ প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। নির্মাণকাজ শেষে গত ১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে হয়ে কক্সবাজার রুটে রেল চলাচল শুরু হয়েছে।

ধীরগতির ঢাকা শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনা আরেক প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। চলতি বছর যানচলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ। বিমানবন্দর থেকে এখন মাত্র ১০ মিনিটেই ফার্মগেট যাওয়া যায়। স্বপ্নের এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১১ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব চুক্তি করে সরকার। ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল রুটের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এবং র‌্যাম্প ও কানেক্টিং লিঙ্কের দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

সেতু কর্তৃপক্ষ পিপিপি প্রকল্পকে সহায়তা করার জন্য ৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের বেসরকারি অংশীদার বিনিয়োগ করছে ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, আর সরকার দিচ্ছে ৭ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না ঋণ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের ৮৬১ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে।

চলতি বছর উদ্বোধন করা হয়েছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম বহুলেন সড়ক টানেল। ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নামে এ টানেলটি দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে।

প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৮ হাজার কোটির কিছুটা কম। পরবর্তীসময়ে সেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চীনের ঋণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

একের পর এক মেগা প্রকল্প যখন দৃশ্যমান হচ্ছে, সেই সময় চাপের মধ্যে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। এটি দেশের সর্বোচ্চ রিজার্ভ। বছর দুই আগে যে রিজার্ভ তরতর করে বেড়েছে, এখন সেই রিজার্ভ ১৯ বিলিয়নের ঘরে।

একদিকে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন দৃশ্যমান হওয়া অন্যদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মেগা প্রকল্প যেগুলো করা হয়েছে, দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য এগুলোর দরকার ছিল। এগুলো ভালো সুফল দেবে। আর রিজার্ভের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিস্থিতিরও প্রভাব রয়েছে। নির্বাচনের আগে এখন তো আর কিছু করার নেই। তবে রিজার্ভ যাতে আরও কমে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রিজার্ভের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিছুটা অর্থনৈতিক পলিসির দুর্বলতার কারণে হয়েছে, কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, সেটা একটা কারণ হিসেবে কাজ করছে এখানে। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে পলিসি দুর্বলতা আছে। যেটা আগে করা উচিত ছিল সেটা করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সুদের হার আরও আগে থেকেই বাড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। নির্বাচনের কারণে এখন অর্থনৈতিক পলিসিগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। ফলে নির্বাচন পর্যন্ত এগুলো চলবে। পরে কী হবে তা নির্ভর করবে নির্বাচনের পরের পরিস্থিতির ওপর। স্থিতিশীল সরকার আসে কি না, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক পলিসিগুলো পরবর্তী সরকার নিতে পারে কি না, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’

রিজার্ভের ওপর চাপ দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তা আড়াল করে দিচ্ছে কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো আড়াল করে দিচ্ছে। উন্নয়ন হয়েছে সেটা ঠিক। প্রকল্প অনেকগুলো হয়েছে বড় বড়। এগুলো নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, এগুলোর দরকার ছিল। আবার অনেক প্রকল্প উচ্চমূল্যে হয়েছে, হয়তো অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় হয়েছে।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এক টাকার জিনিস, দুই টাকা দিয়ে কিনলে তো দুই টাকার রিটার্ন আসবে না, এক টাকার রিটার্ন আসবে। এই প্রকল্পগুলো থেকে সুফল আসবে, তবে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে রি-পেমেন্টের ক্ষেত্রে যে চাপটা আসবে, সেটা আমাদের ঘাড়ে চেপে থাকবে।’

দেশের ভিতরে যে উন্নয়ন হয়েছে তা নিয়ে যতটা আলোচনা না হয়, তার চেয়ে বেশি রিজার্ভ নিয়ে সমালোচনা হয়, এর কারণ কী? জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘এর কারণ হলো উন্নয়নের সুফল তো আর তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না। আজ বঙ্গবন্ধু সেতুর যে সুফল, সেটা অনেক বছর পর পাওয়া যাচ্ছে। কিছু প্রভাব তাৎক্ষণিক হয়, কিন্তু মূল প্রভাব কিছুটা সময় নিয়ে হয়।’


রিজার্ভের ওপর সৃষ্টি হওয়া চাপের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, রিজার্ভ যে অবস্থায় আছে তা কোনো সমস্যা নয়। এখনো তিন মাসের আমদানির সমপরিমাণ আছে। নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক হয়ে আসবে।



© দিন পরিবর্তন