আন্তর্জতিক ডেস্ক
Published:12 Aug 2022, 09:28 AM
জ্বালানি অস্ত্রে ইউরোপ জয় পুতিনের!
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষমতা ধসে পড়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল পশ্চিমা বিশ্ব। তবে ছয় মাস পর উল্টো ফল দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া জ্বালানি গ্যাস ও তেলের জোগান কমিয়ে দিয়ে ইউরোপকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ব্লুুমবার্গে এক নিবন্ধে জ্বালানি ও পণ্যবিষয়ক প্রতিবেদক হাভিয়ের ব্লাস লিখেছেন, চলমান লড়াইয়ে পুতিনের জয়কে নিশ্চিত করছে দেশটির বিপুল জ্বালানি সক্ষমতা।
ব্লুুমবার্গের প্রতিবেদনে তিনি বলেন, যেভাবেই দেখা হোক না কেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন জ্বালানি বাজারে জিতে যাচ্ছেন। মস্কো তেলের খনি থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার আয় করছে। এই মুনাফা তারা ইউক্রেনে সামরিক অভিযান ও নিজ দেশে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন অর্জনের পেছনে খরচ করছে।
রাশিয়ান বাণিজ্যের ওপর নভেম্বরে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা শুরু হলে জ্বালানি সংকট নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে ভোক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়তে পারে। জ্বালানি তেলের বাড়তি চাহিদার কারণে পুতিন ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেবেন। এর ফলে অক্টোবর থেকে ঘরে ও অফিসে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়ে যাবে। যুক্তরাজ্যে দাম বাড়বে প্রায় ৭৫ শতাংশ আর জার্মানিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়বে শতভাগেরও বেশি। জ্বালানিকে রাশিয়া সাফল্যের সঙ্গে অস্ত্রে পরিণত করেছে। পশ্চিমা সরকারগুলো গৃহস্থালি খরচের ভর্তুকি দিতে শত শত কোটি ডলার খরচের চাপে পড়বে। এ সমস্যা নিয়ে ফ্রান্স এরই মধ্যে সমস্যায় পড়েছে। পুতিন যেভাবে জ্বালানি তেলের সুবিধা নিজের দিকে ঘুরিয়েছেন তা রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। গত মাসে দেশটির উৎপাদন যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ব্যারেল উৎপাদন হচ্ছে, যা ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগে জানুয়ারিতে উৎপাদিত ১ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল থেকে সামান্য কম। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত তেলের উৎপাদন ওই হারের চেয়েও বেশি।এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। জুলাইয়ে টানা তৃতীয় মাসের মতো তেলের উৎপাদন আগের অবস্থায় ফিরেছে। চলতি বছর এপ্রিলে ইউরোপীয় দেশগুলো তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ার পর উৎপাদন ১ কোটি ব্যারেলে নেমে এসেছিল। মস্কো তখন বাধ্য হয়ে নতুন ক্রেতা খোঁজায় মনোযোগী হয়।
তার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মার্চ ও এপ্রিলে রাশিয়ার তেলের উৎপাদন দ্রুত কমে যায়। তবে এখন তা ইউক্রেন আক্রমণের আগের অবস্থার কাছাকাছি পর্যায়ে ফিরে এসেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার পর তাদের কাছে প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল বিক্রি করতে পারছিল না মস্কো। তবে এখন তারা নতুন ক্রেতা খুঁজে পেয়েছে।
রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড অয়েল) ক্রেতা এখন এশিয়া, বিশেষ করে ভারত। মধ্যপ্রাচ্য ও তুরকিয়েকেও তারা নতুন ক্রেতা হিসেবে পেয়েছে। ইউরোপেও নভেম্বরে আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞার আগে কিছু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনেছে। ফলে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, রাশিয়ার তেলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় সূচকটি হলো, রাশিয়ান তেলের দাম। প্রাথমিকভাবে মস্কো ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন দেশের কাছে বিশাল ছাড়ে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করেছে। এরপর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ক্রেমলিন একটি আঁঁটসাঁট বাজারের সুবিধা নিয়ে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে।
নতুন এ ধারার ভালো উদাহরণ হচ্ছে ইএসপিও ক্রুড। এটি বিশেষ এক ধরনের তেল, যা রাশিয়ার দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসে। এ বছরের শুরুর দিকে এটি এশিয়ার তেলের বেঞ্চমার্ক দুবাই ক্রুডের কাছে ব্যারেল প্রতি ২০ ডলারের বেশি ছাড়ে বিক্রি করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি ইএসপিও ক্রুড অয়েল দুবাইয়ে তেলের সমতায় পরিবর্তন এনেছে।
রাশিয়ার মধ্যবর্তী ও ইউরোপের নিকটবর্তী উরাল অঞ্চলের ক্রুড অয়েল ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত মস্কো। এখন আর উরাল ক্রুড অয়েল থেকে ইএসপিওর মতো লাভ হচ্ছে না। কারণ এর মূল ক্রেতা ঐতিহ্যগতভাবে জার্মানির মতো দেশ। তবে সম্প্রতি এর দামও আগের মতো হয়ে আসছে।
মস্কো নতুন পণ্যের বাজারও খুঁজছে। এসব বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় এবং যেখানে রাশিয়া অর্থায়ন করে। এরা রাশিয়ার ক্রুড অয়েল কিনতে ও চাহিদার বাজারে পাঠাতে ইচ্ছুক। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি থাকা ও রাশিয়া বিপুল ছাড় দিতে সক্ষম হওয়ায় ক্রেমলিনে প্রচুর অর্থ আসছে। ফলে আপাতত জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না।
রাশিয়ান সাফল্যের সবশেষ সূচকটি সরাসরি বাজার সম্পর্কিত নয়, সেটি রাজনৈতিক। মার্চ ও এপ্রিলে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের আশা ছিল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে ওপেক রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। অথচ বাস্তবে উল্টোটা ঘটেছে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রিয়াদ সফরের পরেও পুতিন ওপেক প্লাস জোটে তার প্রভাব বজায় রেখেছেন। বাইডেন সৌদি আরব থেকে চলে যাওয়ার পরপরই ওপেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী মূল ব্যক্তি রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক সৌদি আরবে যান। তার কয়েক দিন পর ওপেক বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজারের ওপর চাপ বজায় রেখে তেলের উৎপাদন সামান্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।
জ্বালানি বাজারে জয়ের অর্থ হল পুতিন ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি সীমাবদ্ধ করে বার্লিন, প্যারিস ও লন্ডনের ওপর চাপ সৃষ্টির সক্ষমতা রাখেন। এসব দেশ এবারের শীতে রেশনিং হতে পারে এমন খুচরা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও সম্ভাব্য ঘাটতির জন্য প্রস্তুত। মস্কো তেল বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। এ জন্য রাশিয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ সীমিত করে দিলেও বিশেষ ক্ষতির মুখে পড়বে না।
শীতল আবহাওয়া, বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও বছরের শেষ দিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সব মিলিয়ে ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের সমর্থন কমিয়ে দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইউরোপীয় রাজনীতিকরা এতদিন কিয়েভের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রশংসা পেতে আগ্রহী ছিলেন। এখন তারা ভোটারদের জ্বালানি সংকটে পড়া ঠেকাতে নিজের দেশে পণ্যমূল্য বাগে আনতে চাইবেন।
জনসমক্ষে ইউরোপীয় সরকারগুলো রাশিয়ান শক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য দৃঢ়সংকল্পে অটুট। তবে গোপনে তাদের স্বীকার করতেই হচ্ছে, এমন অবস্থান অর্থনীতিতে আঘাতের হুমকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
© দিন পরিবর্তন