নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:14 Jul 2022, 05:03 PM
ধস নামছে প্রবাসী আয়ে
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। যার পরিমাণ পৌনে চার বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের ৩১টি দেশের মধ্যে ২৯টি দেশ থেকেই গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কম এসেছে। এর মধ্যে কেবল সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া থেকে কমেছে সোয়া দুই বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে হুন্ডি কারবার বেড়ে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশিরা কাজ করলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেমিট্যান্স আসে মূলত ৩১টি দেশ থেকে। বিদায়ী অর্থবছরে দুটি ছাড়া সব দেশ থেকেই আয় কমেছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়, কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
গত অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ (২১.০৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার; যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স। অর্থাৎ এবার রেমিট্যান্স কম এসেছে ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধস নেমেছে মালয়েশিয়ার রেমিট্যান্স। এই দেশ থেকে আসা আয় কমেছে ৫০ শতাংশের মতো। গত অর্থবছরে দেশটি থেকে ১০২ কোটি ১৮ লাখ ডলার এসেছে; আগের বছরে এসেছিল ২০২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। শতাংশ হিসাবে কমেছে ৪৯ শতাংশ। এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ কম এসেছে এবার। শতকরা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কমেছে সিঙ্গাপুর থেকে। তৃতীয় অবস্থানে তেলসমৃদ্ধ আরবের দেশ ওমান। শতকরা হিসেবে ২০ শতাংশের মতো পতন হলেও টাকার অঙ্কে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে সৌদি আরব থেকে। ওমান থেকে রেমিট্যান্স কমেছে কমেছে ৪১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত বছর এসেছিল ১.৫৩ বিলিয়ন ডলার। এবার এসেছে ০.৮৯ বিলিয়ন ডলার। সিঙ্গাপুর থেকে কমেছে ৩৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গতবার এসেছিল ৬২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এবার এসেছে ৩৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার। শতকরা হিসেবে ক্রমিকে ৪ নম্বরে থাকলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে সৌদি আরব থেকে আয় কমায়। স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে যে দেশ থেকে, সেটি থেকে গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে ২০ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন সে দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাঠিয়েছেন ৪৫৪ কোটি ১৯ লাখ (৪.৫৪ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ এবার এই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স কম এসেছে ১.১৮ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত অর্থবছরে ২০৭ কোটি ১৮ লাখ (২.০৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। আগের বছরে এসেছিল ২৪৪ কোটি (২.৪৪ বিলিয়ন) ডলার। কমেছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৩৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের দিক থেকে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে আরবের অন্য দেশগুলোর মধ্যে কুয়েত থেকে কমেছে ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা প্রায় ২০ কোটি ডলার; কাতার থেকে কমেছে সাড়ে ১০ কোটি ডলার, যা শতকরা হিসেবে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ।
যদিও করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়। মূলত প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে করোনাজনিত ক্ষতির আশঙ্কা থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ। ওই বছর আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি প্রবাসী আয় আসে। ওই অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে দেশে।
হুন্ডি বন্ধ থাকায় করোনা মহামারিকালে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশী হয়েছে বলে মনে করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়শিয়া থেকে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে আসে। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে সব কিছু বন্ধ থাকায় হুন্ডিও বন্ধ হয়ে যায়। তখন সব টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। সে কারণে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। যার কাছে যা জমানো টাকা ছিল, পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সব বৈধ পথে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারণেই ওই অর্থবছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আবার আগের মতো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। ব্যাংকের চেয়ে কার্বমার্কেট বা খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় বেশি টাকা পাওয়া যাওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন তারা। সে কারণেই এই দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কম আসছে।
দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সুফলও পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করেন প্রবাসীরা।
ইউএসএ-বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক ক্লাবের চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান হাসান বলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসীরা যে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন, তার প্রায় পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলে যাচ্ছে। সে কারণেই এখন বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর পেছনে আছে বাংলাদেশ সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা। এখন যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ টাকা দেশে পাঠান তাহলে তার সঙ্গে বাড়তি আড়াই টাকা প্রণোদনা পান। সে কারণেই প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। হাসানুজ্জামান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। নানা পেশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন তারা। অনেকের উপার্জনও ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকে টাকা রাখলে মুনাফা পাওয়া যায় না। তবে দেশে টাকা পাঠিয়ে প্রবাসী বন্ড কিনলে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়। আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা এবং বন্ড কিনে মুনাফার আশায় এখন ইউএসএ থেকে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা সব মিলিয়ে ১১ লাখের মতো হবে। এর মধ্যে নিউইয়র্কেই থাকেন প্রায় চার লাখ। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস। রেমিট্যান্সের ভাটার মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় পাঠানো দেশ যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান ধরে রেখেছে। কিছুটা কমলেও সেটি অনুল্লেখযোগ্য। আগের অর্থবছরে দেশটি থেকে ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এবার তা কিছুটা কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলাতে আমেরিকা বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রণোদনা ঘোষণা করায় দেশটির অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে সে দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা আগের মতোই রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। একই কারণে যুক্তরাজ্য ও ইতালি থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা।
বায়রা সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা পেশাগতভাবে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছেন। ফলে তাদের উপার্জনও হয় বেশি। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যারা দেশে টাকা পাঠান, তারা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। তাদের অনেকেই আবার বন্ডে বিনিয়োগ করেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, আমেরিকা থেকে যে রেমিট্যান্স অব্যাহত আছে, সেটা একটা ভালো খবর। এটা যদি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স কমে গেলেও সামগ্রিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ যদি ইতিবাচক থাকে, তাহলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো হবে।
রেমিট্যান্সের দিক থেকে ৪ নম্বরে থাকা যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স বরং কিছুটা বেড়েছে। এবার এসেছে ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর ছিল ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন। তবে বিস্ময় দেখিয়েছেন ইতালি প্রবাসীরা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন তারা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসেছিল ৮১ কোটি ৯ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে ১০৫ কোটি ৪২ লাখ ডলার। প্রথমবারের মতো ইউরোপের দেশটি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।
© দিন পরিবর্তন