logo

নাব্যতা সংকটে চিরচেনা রূপ হারাচ্ছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট

নিজস্ব প্রতিনিধি

Published:27 Feb 2024, 04:26 PM

নাব্যতা সংকটে চিরচেনা রূপ হারাচ্ছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট


গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) :

দেশের অভ্যন্তরে বয়ে চলা বৃহৎ দুটি নদীর নাম পদ্মা ও যমুনা। উভয় নদী প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহমান কাল থেকে বয়ে চলেছে। পৃথকভাবে বয়ে চলা দুটি নদীর উৎপত্তি স্থল ভারত হলেও উভয় নদীর মিলিত বা সংযোগস্থল রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রামের কুশাহাটা ও দৌলতদিয়া ইউনিয়ন এলাকায়। আর এই সংযোগ স্থলে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহৎ নৌরুট। যা দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া নৌরুট নামে পরিচিত।এ নৌরুটের এক পাশে রাজবাড়ী জেলা ও অপর পাশে মানিকগঞ্জ জেলা। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া প্রান্তে পদ্মা নদী ও মানিকগঞ্জ প্রান্তে যমুনা নদী। একই সাথে মিশে চলা প্রবাহমান দুই নদীর পানির রং কিন্তু এক নয়। পদ্মার পানি ঘোলাটে আর যমুনার পানি শ্যাওলা বর্নের টলমলা নীলচে-সবুজ।কখনও পদ্মা আর যমুনার পানি রং এক হয়ে মিশে না। পানির রং দেখেই বোঝা যায় কোনটা পদ্মা আর কোনটা যমুনা।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পদ্মার ওই সংযোগ স্থলে তার যৌবনের উত্তাল আগ্রাসী থাবায় হাজার হাজার মানুষের শত শত স্থাপনা ও হাজার হাজার একর ফসিল জমি গ্রাস করে। গত কয়েক বছরে পদ্মার করাল গ্রাসে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া ইউনিয়নের প্রায় ২০-২৫ হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ফেরি ও লঞ্চঘাট ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে করে এরুটে চলাচল করা লক্ষ লক্ষ যাত্রী ভোগান্তির শিকার হয়ে থাকে।

কিন্তু সেই উত্তাল পদ্মা-যমুনা এখন একেবারেই নিরব নিথর। শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে মৃদু ¯্রােতে বয়ে চলা নিশ্চুপ জলাভূমির খালে পরিনত হয়েছে। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে নদীর পানির গভীরতা একেবারে কমে যৌবন হারায়। মার্চ মাসের শেষ দিকে আবার পানি বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে ফুলে ফেঁপে ভরা বর্ষায় আবার যৌবন ফিরে পায়। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার নদীর জৌলুস যেন একটু বেশী হারিয়েছে। পদ্মার নেই কোন হাঁক-ডাক আর আগ্রাসী মনোভাব।

এ যেন চুপসে যাওয়া দুই হাটুতে মাথা গুজে বসে থাকা শতবর্ষিয়ান এক বৃদ্ধ। শতবর্ষের বৃদ্ধ যেমন কৈশোর ও যৌবনে লম্ফ ঝম্ফ দিয়ে চলা সাত সতের ভাবার সময় নাই। কারণে অকারণে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, এক লাফে এগাছ থেকে সেগাছে ওঠা, সাঁতরে পুকুরের এ পাড় থেকে ওপাড় যাওয়া।দৌড়ে পাড়ি জমায় মাইলের পর মাইল পথ। মুহুর্তে গর্জে ওঠা সেই তরুণ বয়সের ভারে শেষ বয়সে এসে শরীর আর চলে না। বাক্য সংকোচিত হয়ে চুপসে যায়। বার্ধক্য জনিত কারণে ধীরে ধীরে সবার কাছে সে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে হƒষ্টপুষ্ট সেই মাংসল দেহ শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে দুই হাঁটুর মাঝে মাথা নুয়ে বসে থাকে।

দেশের বৃহত্তর দুই নদী পদ্মা ও যমুনার পাড়ে দাঁড়ালে এমনই দৃশ্য মনে পড়ে যায়। তবে পার্থক্য হলো নদীর যৌবন প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে হারায় বর্ষায় তা ফিরে পায়। কিন্তু মানুষের যৌবন একবারই আসে, হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না।
সরেজমিন গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাটে পদ্মা পাড়ে দাঁড়িয়ে যৌবন হারানো নদীকে দেখলে যৌবন হারানো বৃদ্ধার কথাই মনে পড়ে যায়।দেখা যায় পদ্মার বুক ভেদ করে জেগে উঠেছে শত শত চর।ওই চরায় বিআইডব্লিউটিসির ফেরি চলাচলে বিঘ্নিত হচ্ছে। মাত্র সাড়ে ৪ কিঃ মিঃ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নদী পথ পার হতে ফেরীগুলোর এক থেকে দেড় ঘন্টা সময় লেগে যায়। যা স্বাভাবিক সময়ে পার হতে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট।

কখনও আবার ড্রেজিং সংকটে নির্দিষ্ট চ্যানেলে চলতে না পারায় ফেরিগুলোকে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার পথ ঘুরে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছাতে হয়। অথচ ভরা বর্ষায় ¯্রােতের টানে ফেরিগুলোকে অনেক দূর ঘুরে ঘাটে ভিড়তে হয়। পদ্মা ও যমুমনার মাঝ বরাবর জেগে ওঠা লম্বা চর দেখলে মনে হয় যেন পদ্মা ও যমুনা পৃথক হয়ে যাবে।এ অবস্থায় দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া নৌরুটের নৌযানগুলোকে চরম সংকটের মোকাবিলা করতে হয়। নাব্যতা সংকটে প্রতিদিনই দুর দুরান্ত থেকে আসা শত শত মালভর্তি কার্গো জাহাজ আটকা পড়ে দৌলতদিয়া ঘাটে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

এ সময় ফেরীর পন্টুনে দাঁড়ালে ২০-২৫ ফুট উঁচু নদীর পাড় ও তার বুকে জেগে থাকা চর দেখা মনে হয় পদ্মা যেন যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া শতবর্ষিয়ান এক বৃদ্ধ। যার নেই কোন শ্রোত, নেই কোন গর্জন, নেই উঁচু উঁচু ঢেউ আর ¯্রােতের বিপরীতে বয়ে চলা নৌযানের যুদ্ধ। নেই হাজার হাজার ঘরবাড়ী ও ফসলি জমি গ্রাস করার দৃশ্য।দৌলতদিয়া পাটুরিয়ায় প্রতিনিয়ত ড্রেজিং বা নদী খননে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে নৌরুটের নাব্যতা ঠিক রাখতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি’র দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের এজিএম আহম্মেদ আলী ও দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, প্রতি বছর জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীতে এই নৌরুটে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। এ সময় ড্রেজিং করে নৌযান চলাচল ঠিক রাখতে হয়। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে আবার পানি বাড়তে শুরু করলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে এবার পানির স্তরটা বেশী নেমে গেছে।

 



© দিন পরিবর্তন