নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:05 Mar 2024, 03:19 PM
নড়েচড়ে বসেছে রাউজক
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বুঝিয়ে দিল বহুতল ভবনে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁ কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। গত বৃহস্পতিবারে গ্রিন কোজি কটেজ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর, নড়েচরে বসেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি বেশ কয়েকটি সংস্থা। এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ ও সিলগালা করা হয়েছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের অভিযানের মধ্যে মানুষের মাঝে বেড়েছে রেস্টুরেন্ট আতঙ্ক। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় হঠাৎ ধাক্কা, কমেছে গ্রাহকের আনাগোনাও। রেস্টুরেন্ট প্রিয়দের মাঝে বেইলি রোডের ঘটনা আতঙ্ক ও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবে হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকে। এই আগুনের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলেও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
ব্যংকার নাজমুল ইসলাম সাত বছরের ছোট মেয়েকে নিয়ে রোববার দুপুরের দিকে বেইলি রোডে এসেছিলেন। অন্যদের সাথে পোড়া ভবনের বিপরীত পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এবং মেয়েকে আঙ্গুল ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন এই সেই ভবন। যেটির আগুনে পুড়ে মরেছে ৪৬টি তরতাজা প্রাণ। আরও দগ্ধ হয়েছে অনেকে।
নাজমুল বলেন, এই তো পাশেই থাকি। কয়েকটি বিল্ডিং পরেই আমার বাসা। ঘটনার দিন আসিনি। আজ আসলাম মেয়েকে দেখাতে। এই ঘটনার পর আসলে ভাববার সময় এসেছে আমরা রেস্টুরেন্টে আর খেতে যাব কিনা। কারণ এই শহরে তো প্রতিদিন কমবেশি আগুনের ঘটনা ঘটছে। আর না ভাবলেও হতো যদি এক একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যরা সচেতন হতো। তাতো হচ্ছে না! আর ঢাকার হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে কোনো ফায়ার এক্সিট পয়েন্ট বা আগুন লাগলে দ্রুত নামার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। এই কারণে আর রেস্টুরেন্টে খেতে যাব না ভেবেছি। দরকার হলে বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে বানিয়ে খাব।
নাজমুলের মতোই অন্যরাও ভাবতে শুরু করেছে। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট প্রিয়দের মাঝে বেইলি রোডের ঘটনা আতঙ্ক ও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবে হোটেল বা রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন অনেকে। এই আগুনের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলেও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
সায়েমা আক্তার এসেছিলেন বাসাবো থেকে। তিনি সেই ভবনের বিপরীত পাশের মার্কেটে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানে কোচিং করেন। তিনি বলছিলেন, আমরা যাদেরকে এগুলোর নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে তারাই যদি তা সঠিকভাবে পালন না করে তাহলে তো হোটেল রেস্টুরেন্টে আর খেতে যাওয়া যাবে না।
বেইলি রোডের পুরো এলাকা জুড়েই রেস্তোরাঁ জোন। এখনো আতঙ্ক কাটেনি এলাকাটিতে। একটি রেস্তোরাঁ গরু-খাসির পায়া, নল্লি ও চুই ঝালের জন্য নাম কুঁড়িয়েছে। এই দোকানের ফুড টেস্টার ও সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার জীবন চৌধুরী বলেন, আমাদের অর্ডার ও অকেশন ছাড়া প্রতিদিন ৩০ কেজি মাংস রান্না করা হয়। শুক্রবার রান্না করা হয় ৪০ কেজি। আর অকেশন বুঝে এটি আরও ২০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আধা বেলা খোলা ছিল দোকান। সেদিন বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬/৭ কেজি মাংস। শনিবার বিক্রি হয় ১৩/১৪ কেজি মাংস। তিনি বলেন, রোববার সকাল থেকেই রেস্তোরাঁ খোলা। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ৯/১০ কেজির বেশি মাংস বিক্রি হয়নি। ক্রেতারা আসছেন কম। আবার যারা আসছেন অনেকেই প্রশ্ন করছেন গ্যাস সিলিন্ডার, নির্গমন পথ, নির্বাপণ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। শুধু তারা নয় আমরাও ভয়ে আছি। আমাদের তিন জন ওয়েটার দুদিন ধরে আসছেন না। ম্যানেজার কিছু বলতেও পারছেন না। আমরা যে সবাই ভয়েই আছি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যুরিজম ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনার্স ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্সসম্পন্ন করা জীবন বলেন, এতগুলো মানুষ মারা গেল আমরা মর্মাহত। বাংলাদেশের রেস্তোরাঁগুলোয় কোনো নিরাপত্তা টুলসই নাই। আমাদের সেই সংস্কৃতিটাই গড়ে ওঠে নাই। আমরা বইয়ের পাতায় যেসব সেফটি টুলস নিয়ে পড়েছি এগুলো শুধু পড়াতেই সীমাবদ্ধ। আমাদের নিরাপত্তার সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠা খুব জরুরি।
ঢাকায় অনার্সসম্পন্ন করে তুরস্কের বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রন্ধনের ওপর ডিগ্রি নিয়েছেন আশিক আহনাফ সৌমিক। তিনি বর্তমানে ধানমণ্ডির জনপ্রিয় একটি রেস্তোরাঁয় চাকরির করছেন। তিনি বলেন, আমাদের কাজটাই চুলার পাশে। বেইলি রোডের ঘটনার পর থেকে ভয় লাগা শুরু করেছে। আগে নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা কনসার্ন ছিলাম না। শেষ দুদিনে আমার পরিবারের সদস্যরা ফোন দিয়ে বলছে সাবধানে থাকতে। আমার আট বছর বয়সী ছেলেটা ফোন দিয়ে বলছে, বাবা সিলিন্ডার থেকে দূরে থাকো। এখন সত্যি ভয় হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের জমে থাকা সিলিন্ডার ও অবস্থান নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় তবে ভিন্ন চিন্তা করবো।
কিছু শৌখিন মানুষরা ফেসবুকে গ্রুপের মাধ্যমে একত্র হয়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর খাবারের স্বাদ নিয়ে থাকেন। এই গ্রুপগুলোতে বড় একটা অংশই শিক্ষার্থী। তারা একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ জন একটি রেস্তোরাঁ খেতে যান। ‘উই আর ফুড লাভার’ নামে ব্যক্তিগত একটি গ্রুপে যুক্ত আছেন ১২২ জন। এই গ্রুপের একজন মডারেটর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়ন্তি দেব নাথ। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন উদ্যাপনের দিনে মাসের শুরুর প্রথম বা দ্বিতীয় শুক্রবার একসঙ্গে খেতে যাই। আমাদের লক্ষ্য থাকে মাসে দু’বার এসঙ্গে নতুন একটি রেস্তোরাঁ খাবার খাওয়া। তিনি বলেন, কিন্তু বেইলি রোডের ঘটনার পর আমরা চলতি মাসের কোনো পরিকল্পনা নিতে পারছি না। অনেকের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। প্রাথমিক একটা আলোচনা ছিল শুক্রবার (৮ই মার্চ) খেতে যাবার। কিন্তু অনেকের মাঝে নেই আগ্রহ।
প্রিয়ন্তি বলেন, আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের এই গ্রুপ লিপ ইয়ার উদ্যাপনের উদ্দেশে বেইলি রোডেই অন্য একটি রেস্তোরাঁ খেতে গিয়েছিলাম। আগুন লাগার আধা ঘণ্টা আগে আমরা খাওয়া শেষে বইমেলার দিকে যাই। আমরাও এই ভয়ানক ঘটনার শিকার হতে পারতাম। এখন আমরা হয়তো আর রেস্তোরাঁ খেতে যাবো না। গেলেও হিসাবনিকাশ করেই যাবো।
এদিকে, রাজধানীর ধানমণ্ডির সাতমসজিদ সড়কের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনে একটি রুফটপ রেস্তোরাঁ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালা করে দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলছেন, ভবনটিতে অফিস করার অনুমতি থাকলেও রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। গত ২৩ মে রাজউক এই ভবন পরিদর্শনে এসে নোটিশ দিয়েছিল। গতকাল সোমবার রাজউকের অঞ্চল-৩ এর পরিচালক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার এই অভিযান পরিচালনা করেন। বেলা ১১টার পর অভিযান শুরু হয়। তবে এর আগেই ভবনের রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট টুইন পিক ভবনটিতে এফ-১এর অনুমোদন ছিল বলে জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু রেস্তোরাঁ হিসেবে নয়। এ ছাড়া কোনো রেস্তোরাঁই ব্যবসার জন্য জেলা প্রশাসনের অনুমোদন নেয়নি বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, যেসব ভবন সিলগালা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর আদেশ ঢাকা জেলা প্রশাসনে বরাবর পাঠানো হবে। তারা পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেবে। অভিযানে স্পাইস হারবস নামের একটি রেস্তোরাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মালিক রাইসুল আলম খান বলেন, রেস্টুরেন্ট করা যাবে না, তা জানতাম না। জেলা প্রশাসনের অনুমোদনও জানা ছিল না। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে রেস্তোরাঁ করেছি। আমাদের দোষটা কোথায়? এখন আমরা কী করব?
গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ডেভেলপার কর্তৃপক্ষের লজিস্টিক ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, স্থপতি যেভাবে ভবন নকশা করেছেন, সেভাবেই চলছে। তারা বাণিজ্যিক হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রেস্তোরাঁর অনুমোদন নিয়েছেন। তবে সেখানে রাজউকের নকশার শর্ত ছিল। রাজউক এফ-১ এর অনুমোদন দেয়। সারা ঢাকায় এফ-১ হলেও রেস্তোরাঁ করা যায়, সেটা স্থপতিই বলেছেন বলে জানান তিনি।
শহিদুল ইসলাম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুধু এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তারপর এটি ভবন মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ভবনের মালিক বেশ কয়েকজন। তাঁরা নিজেদের মতো করে রেস্তোরাঁ ভাড়া দিয়েছেন।
রাজউক জানিয়েছে, যেসব রেস্তোরাঁয় কর্তৃপক্ষ পাওয়া গেছে, তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। তাদের এ অভিযান চলমান থাকবে।
© দিন পরিবর্তন