নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:01 Jul 2022, 11:06 AM
পশু হাটের ইজারা পেলেন আ.লীগ নেতারা
পশুর হাটের ইজারা প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা নেই। তাই আসন্ন কোরবানির ঈদে রাজধানীর অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা দেওয়ায় হয়েছে নয়-ছয়। সিন্ডিকেট করে হাটগুলোর ইজারা নিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতারা। এতে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
গাবতলীর স্থায়ী হাট ছাড়া এবার কোরবানির ঈদে রাজধানীতে ২০টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ১৫টির ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) তাদের ১০টি অস্থায়ী হাটের ইজারা প্রক্রিয়া শেষ করেছে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) পাঁচটি হাটের ইজারা প্রক্রিয়া শেষ করেছে। বাকি পাঁচটির বিষয় এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
চূড়ান্ত হওয়া হাটগুলোর ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তাছাড়া সহযোগী সংগঠন, জাতীয় পার্টি, সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলরদের ঘনিষ্ঠজনরাই হাটের ইজারা পেয়েছেন বলে জানা গেছে। ইজারা প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক না থাকায় এককালীন বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে সিটি করপোরেশন বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় হাট না পাওয়া একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন ইজারা দেওয়ার আগেই স্থানীয় পর্যায়ে বেশিরভাগ হাট কারা নেবে তা চূড়ান্ত হয়ে যায়। তাই নির্ধারিত নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কেউ ইজারা প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চান না। যদিও প্রতি বছরই অস্থায়ী হাট থেকে এককালীন বড় অংকের রাজস্ব আসে। তবে ইজারায় সরকারদলীয় লোকজনের প্রাধান্য থাকায় দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন না অনেক ব্যবসায়ী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইজারা প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ে।
ডিএনসিসির হাটগুলো যারা পেয়েছেন ইজারা :
ডিএনসিসির ১০টি অস্থায়ী হাটের মধ্যে আটটির জন্য দরপত্র আহ্বান করে
ডিএনসিসি। এর মধ্যে পাঁচটি হাটের ইজারা চূড়ান্ত হয়েছে। এই পাঁচটি হাটের
চারটিরই ইজারা পেয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের
নেতাকর্মীরা। অন্যটিরও ইজারা পেয়েছেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা।
খোঁজ
নিয়ে জানা যায়, কাওলা শিয়ালডাঙ্গা হাটটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা
পেয়েছেন তৌফিকুর রহমান। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান নাঈমের
ব্যক্তিগত সহকারী এবং দক্ষিণখান থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত
সভাপতি। উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ পর্যন্ত
খালি জায়গার হাটটি এক কোটি ২০ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন মো. নূর হোসেন।
তিনি তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক। ভাটারা (সাঈদনগর) হাট তিন কোটি
৩০ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন মো. সুরুজ্জামান। তিনি ভাটারা থানা আওয়ামী
লীগের সহসভাপতি। বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং আফতাবনগর ব্লক ই থেকে এইট পর্যন্ত
এলাকার হাটটি এক কোটি ৪৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন মিজানুর রহমান
ধনু। তিনি ২১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তাসংলগ্ন খালি জায়গার হাট ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনাল। এই কোম্পানির মালিক মো. আমজাদ হোসেন দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য।
৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন খালি জায়গা, মিরপুর সেকশন-৬ এর খালি জায়গা এবং ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচপুরা বেপারিপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্প এলাকার হাটগুলোর ইজারা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এগুলোর জন্য তৃতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করেছে সিটি করপোরেশন। তাছাড়া তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল খেলার মাঠ ও এর আশপাশের খালি জায়গা এবং মহাখালী টিঅ্যান্ডটি মোড় খেলার মাঠে হাট বসাতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা আবেদন করেছেন। সে হিসেবে ডিএনসিসি এলাকায়ও ১০টি অস্থায়ী হাট বসতে পারে।
ডিএসসিসির ১০ অস্থায়ী হাট কারা পেলেন : ডিএসসিসির ১০টি হাটের মধ্যে নয়টির ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার নেতাকর্মীরা। একটি হাটের ইজারা পেয়েছেন জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্যের ভাগ্নে। উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘ ক্লাব মাঠের হাটটি এক কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন এএসএম এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আব্দুল লতিফ। তিনি শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। হাজারীবাগ ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ হাটটি তিন কোটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫৫ টাকায় ইজারা পেয়েছেন অহিদুর রহমান ওয়াকিব। তিনি ঢাকা-৭ আসনের সরকারদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। তাছাড়া হাজারীবাগ রোড ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গার হাট দুই কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন চিশতী।
মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা হাট এক কোটি ৯০ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন মো. আওরঙ্গজেব টিটু। তিনি ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য এবং ঢাকা মহানগর ৩ দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক।
লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গা ও
কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বিশ্বরোডের আশপাশের খালি জায়গা হাটটি তিন কোটি ১৩
লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন খান ট্রেডার্সের মালিক গোলাম কিবরিয়া রাজা খান।
তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজ
সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গার হাট চার কোটি ৪০ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছেন গিয়াস
উদ্দিন গেসু। তিনি ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ধোলাইখাল
ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকার হাটটি চার কোটি পাঁচ হাজার টাকায়
ইজারা পেয়েছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি ৮৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ
সম্পাদক।
লালবাগ রহমতগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা হাট ৫০ লাখ
১০ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন ঢাকা-৭ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাজী
সেলিমের বড় ছেলে সোলায়মান সেলিম। তিনি গত সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী
লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
শ্যামপুর কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি জায়গা হাট ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছেন মাসুক রহমান। তিনি ঢাকা-৪ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলার ভাগ্নে। আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গা হাটটি ৩৫ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছে স্থানীয় যুবলীগ নেতা নওশের আলী। এছাড়াও দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা গাবতলী ও ডেমরার সারুলিয়ারও স্থায়ী হাট বসবে।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন ঢাকা বলেন, ইজারা প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। শতভাগ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়েছে, দরপত্র সবার জন্য উন্মুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ইজারায় অংশ নিতে পারবেন না, এমন কোনো নিয়ম নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা ড. মাহে আলম বলেন, ইজারা প্রক্রিয়ায় শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ দরদাতাকেই হাটের ইজারা দেওয়া হয়েছে।
© দিন পরিবর্তন