নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:03 Mar 2024, 08:04 PM
পুরান ঢাকা এখনও ‘বোমা’র শহর
বেইলি রোডে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর আবারও আলোচনায় এসেছে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনগুলো। নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার পরও গোডাউনগুলো স্থানান্তর করা যায়নি জনবহুল এসব এলাকা থেকে।সরকারের পক্ষ থেকে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ১৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি সেটি। আর কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করলেও ব্যবসার স্বার্থে গোডাউন স্থানান্তরে রাজি নন।
শনিবার (২ মার্চ) পুরান ঢাকার চকবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেমিক্যালের দোকানগুলো চলছে আগের মতোই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লালবাগ, চকবাজার, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড এলাকায় বসতবাড়িসহ অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোডাউন করে রাখা হয় কেমিক্যাল। আর এসব কেমিক্যাল লোড করা হয় রাতে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদকের কাছে গোডাউন থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তারা বলেন, ছোট ব্যবসায়ী বলে তাদের কোনও গোডাউন নেই। দোকানে যতটুকু ধরে ততটুকু মাল রাখেন তারা। অর্ডার পেলে মাল আনেন অথবা বড় দোকান থেকে ব্যবস্থা করেন। তবে বসতবাড়িসহ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোডাউন থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও সেগুলো বড় দোকানদারদের বলে দাবি তাদের।
এ বিষয়ে কথা বলা হয় রূপসা কেমিক্যালের ম্যানেজার হামিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দোকান বড় বা ছোট বিষয় না, গোডাউন সবারই আছে। পুরান ঢাকায় সব বাড়ির নিচেই কমবেশি গোডাউন আছে। তবে এখন কিছু গোডাউন কেরানীগঞ্জে নেওয়া হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে।’
গোডাউন থাকার সত্যতা মেলে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, দিনের এখানে মাল লোড হয় না, রাতে কেমিক্যাল আসে। তারাই গোডাউনে কেমিক্যালের ড্রামগুলো নিয়ে রাখেন।
শ্রমিক আখতার বলেন, ‘রাতে গাড়ি এলে আমাদের ডাকে। প্রতিরাতেই গাড়ি আসে। আমরা মাল গাড়ি থেকে নিয়ে গোডাউনে দিই। এখন বাড়ির নিচে না দোকানের নিচে গোডাউন এটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আর এদিকে বাড়ির নিচে ছাড়া গোডাউন কোথায় পাবেন। নতুন বাড়িগুলোতে গোডাউন নেই। পুরাতন সব বাড়ির নিচে গোডাউন আছে।’
২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয় ১২৪ তাজা প্রাণ, আর ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় ৭১ জন। এই দুই ঘটনার পরই গোডাউনগুলো স্থানান্তর করার উদ্যোগ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। তবে অজানা কারণে এত বছর পার হলেও স্থানান্তরের জন্য স্থায়ী প্রকল্প চালু করা যায়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় আনুমানিক ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা কেমিক্যাল পণ্যের গুদাম রয়েছে। এসবের মধ্যে ১৫ হাজারই রয়েছে বাসাবাড়িতে। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদাম অবৈধ। ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবসা চলে সেসব গুদামে।
এসব গোডাউনে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোজ, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইল, টলুইনের মতো দাহ্য পদার্থ। ফলে যেকোনও মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা তো নিরাপদ স্থানে গোডাউন নিতে আগ্রহী। কিন্তু আমাদের তো ব্যবসা থাকতে হবে। সরকার যে জায়গা আমাদের দিচ্ছে সেখানে গোডাউনে প্রতি বর্গফুট ভাড়া ৫০ টাকা। আমরা পুরান ঢাকায় ১২ টাকায় ভাড়া পাই। আমরা সরকারকে বলেছিলাম যেভাবে ট্যানারি, গার্মেন্টস সরানো হয়েছে, আমাদেরও জায়গা দিক, আমরা গোডাউন তুলে ব্যবসা করবো। সামনে আবার মিটিং আছে, দেখি এখন কী বলে তারা। এভাবে তো সমাধান হয় না। আমরাও নিরাপদে ব্যবসা করতে চাই।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘জনবসতিপূর্ণ এলাকা, গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কেমিক্যাল গোডাউন থাকতে পারে না। এটা অতিসত্বর সরিয়ে নেওয়া দরকার। যখন কমিটি গঠন হয়েছিল গোডাউন স্থানান্তরের জন্য, আমি তখন দায়িত্বে ছিলাম না। তবে যতদূর জানি, কাজ চলছে এটা নিয়ে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নগর পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহারিয়ার আমিন বলেন, ‘পুরান ঢাকার সমস্যা হচ্ছে আমরা আমাদের বাসস্থানকে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছি। কিন্তু কালের আবর্তনে ব্যবসাকেন্দ্রকে আমরা স্থানান্তর করিনি। বড় কোনও দুর্ঘটনা হলেই আমরা আইন করি কিন্তু প্রয়োগ করি না। কিন্তু পুরান ঢাকার মতো জনবহুল জায়গায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আবারও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর জন্য সরকার বা যারা দায়িত্বে আছেন তাদের অতিসত্বর গোডাউনগুলো স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।’
/মামুন
© দিন পরিবর্তন