দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:11 Dec 2023, 08:08 PM
পেঁয়াজের উচ্চমূল্য: সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে
মোবারক হোসেন
পেঁয়াজ নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। কৃষিভিত্তিক এ পণ্যটি ছাড়া শাক-সবজি, মাছ-মাংস, তরি-তরকারি- এক কথায় রান্নাবান্না একেবারে অচল। রান্না করা ওই সব খাদ্যের স্বাদের মান বাড়াতে পেঁয়াজ অদ্বিতীয়। এ কারণে যুগ যুগ ধরে রান্নাঘরে পেঁয়াজ একটা অনন্য আসন অধিকার করে আছে। ধনী-গরিব সবার ঘরে পেঁয়াজের চাহিদা সমান। সেই সঙ্গে গুরুত্বও সমান। পেঁয়াজ ছাড়া যেন কারোরই চলে না।
সেই নিত্যপণ্য পেঁয়াজ কয়েক সপ্তাহ ধরে হঠাৎ উচ্চমূল্য ধারণ করেছে। আগে ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ লাফাতে লাফাতে ৬০-৭০ হয়, এরপর আরেক দফা বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় কেনাবেচা চলছিল। এক রাতের ব্যবধানে আবার বেড়ে ২২০ টাকায় ঠেকেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর আরেকটি কারণ সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কারণে হটাৎ বাজার ঊর্ধ্বগতি ধারণ করেছে। সামনের দিনগুলোয় আরো মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ এই মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলেছে।
দৈনিক দিনপরিবর্তনে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২০ টাকার পেঁয়াজ একদিনে ২০০ টাকা। অভিযানে ২২০ টাকার পেঁয়াজ নেমে আসে ১০০ টাকায়। সারা দেশে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে পেঁয়াজ এক-দেড় বছর আগে ২০-২৫ টাকা দরে সাধারণ ক্রেতারা কিনে এসেছেন, তা হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করলো কেন? আবার অভিযানে নামলে মূল্য অর্ধেক কমে যায়। আমদানিতে ঘাটতি তৈরি হলে দেশীয় সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়- এটাও ঠিক।
আমাদের পেঁয়াজের বাজার দুই ধরনের পেঁয়াজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ আর ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ। অবশ্য কিছু পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হয়; তবে দেশি ও ভারতীয় এই দুই ধরনের পেঁয়াজই আমাদের প্রধান চাহিদাটা মেটায়। যাক সে কথা।
গত এক বছরে সামান্য ব্যবধানে ক্রেতারা পেঁয়াজ কিনে এসেছেন। দেশি পেঁয়াজ ছিল ৩০ টাকা আর ভারতীয়টা ছিল ২৫ টাকা। এই মূল্য ব্যবধানে ক্রেতারা খুচরা বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনেছেন। আসল কথা হলো, হঠাৎ করে পেঁয়াজের এত ব্যাপক মাত্রায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটলো কেন?
সরবরাহ-সংকট আর মূল্যবৃদ্ধি দুটোই যেন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। এ সংকটের চাপে পড়ে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আমাদের দেশি পেঁয়াজের মূল্য। খুচরা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবে বাজারমূল্য রুখতে পারছেন না। আর এর প্রভাবটা গিয়ে পড়ছে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর। শুধু তাই নয়, যদিও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে নির্দিষ্ট করা কোনো আমদানি-মূল্য নেই। তবে ব্যবসায়ীরা কিনছেন কম মূল্যে আর বিক্রি করছেন চড়া মূল্যে- ঊর্ধ্বমূল্যের আসল কারণটা এখানেই নিহিত।
দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের পেঁয়াজ বাজারের মূল্য-ভারসাম্য ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল। দেশে চাহিদার অনুপাতে উৎপাদন কম হওয়ার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তবে এটা ঠিক, দেশে যে পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় তা গুণে ও মানে ভারতীয় পেঁয়াজের চেয়ে অনেক উত্তম। ভারতীয় পেঁয়াজ হাইব্রিড পদ্ধতিতে চাষ করা হয়- এমনটা শোনা যায় । এ কারণে নাকি এ পেঁয়াজ সাইজে বড়, ফলনে বেশি, উৎপাদন খরচও কম। উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় ভারতীয় কৃষকরা আবহাওয়াগত কারণে স্বল্প শ্রমে কম জমিতে অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপন্ন করতে পারেন। যার কারণে উপাদন খরচ কমে যায় এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত অংশ রপ্তানি করতে পারেন। এ কারণে পরিবহন খরচ, বিভিন্ন ট্যাক্স ও বন্দরের শুল্ক-ব্যয় মিটিয়ে বাংলাদেশে রপ্তানি করে স্থানীয় দেশি পেঁয়াজের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারে। ফলে সারা বছর ভারতীয় পেঁয়াজের আলাদা আধিপত্য থাকে বাংলাদেশের বাজারজুড়ে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশ। এদেশেও প্রচুর পরিমাণে উন্নত গুণ ও মানের পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। কিন্তু চাহিদার সীমারেখা পুরোপুরি অতিক্রম করতে পারে না। এই শূন্যতা পূরণ করা হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমদানি করে। এই নির্ভরতা চলে আসছে সময়ের ধারাবাহিকতায়।
আমাদের দেশে কৃষিবিদগণ দেশে পেঁয়াজের চাহিদা, উৎপাদন, মান - এসব নিয়ে কতটা গবেষণা করেন এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায় কম। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, পেঁয়াজের বিষয়ে যে দৈন্যতা চলমান, এসব সংকট নিয়ে আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, যা নেয়া হয়নি।
কৃষিপ্রধান যে দেশ বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, সে দেশে কেন দিনের পর দিন কৃষিপণ্য আমদানি করতে হবে? আমাদের কি উপযোগী কৃষিজমি, প্রয়োজনীয় কৃষক, সেই সঙ্গে প্রযুক্তি জ্ঞান নেই? প্রতিবেশী দেশ যদি স্বল্প মূল্যের উপশী জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারে? তাহলে আমরা পারবো না কেন? এবং এত দিনই বা পারিনি কেন? এসব প্রশ্নের জবাব আজ তাদের কাছেই খুঁজতে হচ্ছে, যারা গবেষণা করে অনেক কৃষিফসল এগিয়ে নিয়েছেন। উৎপাদনে যদি সার্বিক পরিকল্পনা থাকতো, তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন করা বড় কোনো বাধা হয়ে থাকার কথা নয়।
কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে আমরা পেঁয়াজ আমদানি করি। যে মুদ্রা দেশের কৃষকের ঘর থাকার কথা, সে মুদ্রা আমদানি ব্যয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশি কৃষকের ঘরে।
দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্র বগুড়ার এক ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কয়েক বছর আগে মন্তব্য করেন, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদন প্রায় কাছাকাছি। দেশের কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে প্রকৃত নিয়ম অনুসরণ করেন না। যেখানে পেঁয়াজ মৌসুমে চার থেকে পাঁচটা সেচ দরকার, সেখানে ছয়-সাতটা দেয়া হয়। এতে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। ফলে সংরক্ষণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া চাষকালে রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহারের কারণে পেঁয়াজে দ্রুত পচন ধরে। এতেও সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে পেঁয়াজ ঘরে তোলার পর ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পচে নষ্ট হয়ে যায়। রাজশাহীর তাহিরপুর, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, বৃহত্তর পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, মাগুড়া প্রভৃতি এলাকায় পর্যাপ্ত পেঁয়াজের উৎপাদন হয়।
ভারত থেকে যে পেঁয়াজ আসে তাকে উপশী বলতে নারাজ ড. আশিকুল ইসলাম। তার মতে, ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে যে পেঁয়াজ আসে সেগুলো হাইব্রিড নয়। মহারাষ্ট্রে এমনিতে বৃষ্টিপাত কম, তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি থাকে। এতে পেঁয়াজে পচন ধরে না। আর ওখানকার মাটিও পেঁয়াজ চাষের উপযোগী। ওই সব এলাকার পেঁয়াজ এদেশে আমদানি করা হলে আবহাওয়াগত কারণে পেঁয়াজের খোসা উঠে যায়। দেখতে দৃষ্টিকটু হলেও কোনো বিরূপ প্রভাব নেই।
ড. আশিকুল ইসলামের যুক্তি যদি বাস্তবিক অর্থে সঠিক হয়, তাহলে ‘মাত্রাতিরিক্ত সেচ ও ইউরিয়া’ ব্যবহারে কেন কৃষকের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা পেঁয়াজের মতো পচে নষ্ট হয়ে যাবে। দেশের প্রতিটি এলাকায় কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজাররা রয়েছেন। ওই সব কৃষিকর্মীদের মাধ্যমে তৃণমূলের পেঁয়াজ চাষিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও মাঠ পর্যায়ে উপযুক্ত তদারকী করলে কি সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না? উৎপাদন সক্ষমতার সম্ভাবনার দ্বারে দাঁড়িয়ে শুধু কৌশলগত কারণে তা নষ্ট হয়ে যাবে- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে কি?
দেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন কৃষি বিভাগ আছে, গবেষণা কেন্দ্র আছে- তারা কোনোভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। এদেশের কৃষককে বিভিন্ন ফসল চাষে উপযুক্ত করে তোলা তাদেরই দায়িত্ব। কৃষক উৎপাদন করলো, কৌশলগত জ্ঞানের অভাবে তাদের পণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হতে থাকলো আর বছরের পর বছর দেশ ঘাটতিতে পড়ে আমদানি করতে থাকলো Ñ এটা চলতে পারে না। যাক সে কথা।
সরকার বিভিন্ন ফসলে কৃষিঋণ দিচ্ছে। এবারও কয়েকটি কৃষিপণ্য নতুন করে কৃষিঋণের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জনে কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায় না। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে এবং দেশের কৃষকদের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে আমাদের পেঁয়াজ চাষাবাদ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করা দরকার। দেশ স্বনির্ভর করতে হলে আগে আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। তাহলেই কেবল দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যেসব পণ্য এখনো আমদানি করা হচ্ছে, সেসব পণ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যাতে উৎপাদনের মাত্রা চাহিদার কাছাকাছি যেতে পারে, তাহলে ক্রমেই আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে দেশে উন্নয়নের শুভযাত্রা পরিপূর্ণ করা সম্ভব। দেশে যেসব এলাকায় পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় এবং যেসব কৃষক পেঁয়াজ উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট; তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। আর সরকারি ঋণ-সহায়তা দেয়া প্রয়োজন হলে কেবল ওইসব পেশাদার পেঁয়াজচাষিদের জন্যই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাহলে কেবল সম্ভব লক্ষ্য অর্জন করা।
লেখক: সাংবাদিক
© দিন পরিবর্তন