দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:03 Apr 2022, 12:07 PM
প্রকাশনা শিল্পকে যেখানে রেখে গেলেন মহিউদ্দিন আহমেদ : ফিরোজ আহমেদ
মহিউদ্দিন আহমেদকে বনানী কবরস্থানে যখন শুইয়ে দেয়া হচ্ছিল, সামান্য কয়েকজন মানুষই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেটার একমাত্র কারণ তাঁর পরিবারের সদস্যরা এমনই নিভৃতি চেয়েছিলেন কর্মব্যস্ত এই মানুষটির বিদায় মুহূর্তে। কিন্তু এই পথপ্রদর্শক মানুষটিকে নিয়ে গণমাধ্যম ও অন্যত্র যে আলোচনাটি হবার কথা ছিল নিছক মহিউদ্দিন আহমেদকে স্মরণ করবার জন্য নয়, আমাদের জাতিগত স্বার্থেই সেটি কতখানি দেখছি আমরা?
১.
আহমদ ছফার জবানিতে অধ্যাপক রাজ্জাকের বহুল উদ্ধৃত কথাটি দিয়েই মহিউদ্দিন আহমেদের স্মরণে একটি লেখার শুরু হতে পারে: ‘একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন একটা নতুন জায়গায় যাবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। অই জায়গার মানুষ কী খায় আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন কী খায় হেইডা দেহনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা। ...কী খায় আর কী পড়ে এই দুইডা জিনিস না জানলে একটা জাতির কিছু জানন যায় না।’
বাংলাদেশে কী পড়া হয়, সেই হিসেবে যদি আসতে চাই, ‘আপাতদৃষ্টে’ অন্তত মনে হয় মহিউদ্দিন আহমেদের জীবনের সংগ্রাম সফল হয়নি, যে পদ্ধতিতে এবং যে ধরনের গ্রন্থ প্রকাশে মহিউদ্দিন আহমেদ এবং তার প্রতিষ্ঠান ইউপিএল বলা যায় পথপ্রদর্শক, তার পরিসর বাংলাদেশে ক্রমশ কমে এসেছে। খুব সম্ভবত মহিউদ্দিন আহমেদের জীবদ্দশাতেই এই পিছু হটা ঘটে গেছে। ব্যক্তিগত শিক্ষাদীক্ষায় মহিউদ্দিন আহমেদের যা যোগ্যতা ছিল, তাতে তিনি অনায়াসেই বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা বা সাংবাদিকতা-সহ অন্য বহু পেশায় অনায়াসে দারুণ সফল হতে পারতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউপিএলও অসফল নয়, অন্তত বাণিজ্যিক বিচারে। এর সাথে মহীরূহতুল্য যে খ্যাতি তিনি জীবিত অবস্থাতেই অর্জন করেছেন প্রকাশনাশিল্পে, সেটাও একজীবনের অর্জন হিসেবে বিপুল। কিন্তু যে ‘জ্ঞানভিত্তিক’ সমাজ গড়ার নেশায় প্রকাশনাকেই তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, এবং একটা বিশেষ ধরনের প্রকাশনাকে প্রতিষ্ঠিত করার ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিজ্ঞায় আজীবন লিপ্ত ছিলেন, সেটার স্থান সংকুচিত হওয়াকে জীবিত অবস্থাতেই তিনি দেখে গিয়েছেন। জানি না তাঁর জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটি কতটা দুঃখের ছিল, তবে আমাদের গোটা জাতির জন্যই এটি একটি মর্মান্তিক বাস্তবতা।
২.
মহিউদ্দিন আহমেদের অর্জন কী? একটা তুলনা করা যাক আরেকজন প্রবাদপ্রতিম প্রকাশকের সাথে, তিনি মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা। বাংলাদেশের অজস্র লেখকের তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রকাশক। পুঁথিঘর লিমিটেডের নোট বই থেকে চিত্তরঞ্জন সাহা যা আয় করেছেন, তার একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন বাংলাভাষার লেখকদের পেছনে। এটা সন্দেহাতীতভাবেই একটা বড় কৃতিত্ব, নোট বইয়ের হাতে শিক্ষা ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি যতই সম্পর্কিত থাক না কেন। নোট বইয়ের বাস্তবতা চিত্তরঞ্জন সাহা তৈরি করেননি, তিনি শুধু ঘাটতিটুকু পূরণ করেছেন। কিন্তু অর্জিত অর্থ অকাতরে খরচ করেছেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতায়।
অন্যদিকে বিশেষকরে ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে প্রকাশিত বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমকালীন ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা-গ্রন্থগুলোর দিকে তাকান, প্রায় অধিকাংশ প্রকাশিত হয়েছিল মহিউদ্দিন আহমেদের তৈরি করা প্রতিষ্ঠান থেকে। অন্য কোনো সরকারি/বেসরকারি/আধাসরকারি ‘বৃহৎ’ প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে তার সাথে প্রতিদ্বন্ধীতায় আসতে পারবে না, বাংলা একাডেমির প্রকাশিত প্রাচীন ইতিহাস ও পুঁথিসাহিত্যের ভাণ্ডারকে বিবেচনা থেকে বাদ দিলে। এ বিষয়ে আমার সাক্ষ্য মূল্যবান, কেননা আমি নিজে তেমন বড় বইয়ের সংগ্রাহক নই, নতুন বই কেনা এড়িয়ে চলি, এবং পারতপক্ষে দামি বই কিনি না, বাধ্য না হলে কোনো বইই না। প্রধানত ইউপিএল-এর বই কিনেছি ফুটপাথ থেকে, সেগুলো দাম হারাবার পরই, কেননা তাদের নতুন বই কেনার সাধ্য আমার ছিলও না। পাঠাগারে যেয়ে কিংবা অন্যের থেকে ধার করেই পড়ার অভ্যাস করেছি। এত কৃপণতার পরও যখনই রাতের বেলা নিজের বইয়ের তাকগুলোর দিকে তাকাই, মনে হয় দেয়ালে ইউপিএল-এর একটা প্রদর্শনী চলছে। এটা কোনো সচেতন বাছাই ছিল না, বলা যায় ফুটপাথে গবেষণামূলক বইপত্রের যা যা আসে চুঁইয়ে চুঁইয়ে, তারই একটা সাধারণ প্রতিফলন মাত্র, বাধ্য হয়ে যেগুলো কিনতে হয়েছিল নানান কাজে। গত চল্লিশ বছরে গবেষণামূলক সা¤প্রতিক গ্রন্থ প্রকাশে ইউপিএল-এর ধারেকাছে যাবার সামর্থ্য বাংলাদেশের বাকি প্রকাশনা সংস্থার একত্রে মিলেও হবে না।
কেনো এমনটা হয়েছে? কারণ সম্ভবত এটা যে, মহিউদ্দিন আহমেদের আগে বই বিষয়ে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দেশে ছিলেন না। ফলে প্রকাশনার কাজটি এর আগ পর্যন্ত ছিল প্রধানত একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। প্রশিক্ষণের এই বিষয়টাকে কয়েকটা দিক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যায়। একটা দিকে আছে পাণ্ডলিপি বাছাই। আরেকটা দিকে আছে সম্পাদনা।
একটামাত্র উদাহরণে প্রথম বিষয়টা, অর্থাৎ পাণ্ডলিপি বাছাই বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ূ, কৃষি, উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে প্রধানতম গবেষক হিউ ব্রামারের অসাধারণ সব গ্রন্থ কিভাবে প্রকাশিত হলো, মহিউদ্দিন আহমেদের সেই বিষয়ক স্মৃতিচারণে শোনা যাক: “১৯৯৬-এর দিকে তিনি আমার অফিসে এলেন। তত দিনে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, কাজ থেকে নয়। মানুষ টায়ার্ড হয়ে রিটায়ার্ড হয়। তিনি হননি। আমাকে বললেন, ‘বাংলাদেশে এত বছর কাজ করেছি। প্রচুর আর্কাইভাল ম্যাটেরিয়াল আছে। এগুলো কী করব বুঝতে পারছি না।’ জিজ্ঞেস করলাম, লেখা-টেখা আছে? বললেন, ‘লেখা মানে কী! আমার কম্পিউটার ভর্তি বাংলাদেশ নিয়ে নানা লেখা।’ কৃষি, মাটি, ভূগোল– পুরো দেশটাই তাঁর নখদর্পণে।” [রানা আব্বাস; ব্রিটিশ গবেষক হিউ ব্রামার: ভালোবাসি বাংলাদেশ, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, দৈনিক প্রথম আলো]
বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রকাশক তৈরি হওয়া পাণ্ডলিপি নিয়ে কাজ করেন। একজন পণ্ডিত বা বিদ্যৎজনের সাথে আলাপের ভিত্তিতে তাকে পাণ্ডলিপি তৈরি করতে বসিয়ে দেয়া, এটি হলো খাঁটি প্রকাশকের প্রধান কাজ, তাতে তার বই লেখার কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকুক।
মাত্র কদিন আগেই পড়ছিলাম ‘দ্যা স্কোয়াটারস অব ঢাকা সিটি’ নামে অধুনালুপ্ত আগারগাঁও বস্তি নিয়ে একটা গবেষণা গ্রন্থ, প্রতিমা পাল-মজুমদার, সিমিন মাহমুদ আর রিতা আফসার এই তিন জন মিলে অসাধারণ গবেষণাটি করেছিলেন। আশি ও নব্বই দশকের বস্তি জীবন, বরিশাল-নোয়াখালী-রংপুর-জামালপুর-কুমিল্লা জেলা থেকে অভিবাসী হয়ে ঢাকায় আসা মানুষগুলোর জীবনের নানান দিক নিয়ে একটা পরিপূর্ণ অথচ ক্ষীণকায় গবেষণাগ্রন্থ– মহিউদ্দিন আহমেদের মতো মানুষ এবং ইউপিএল না থাকলে এমন অজস্র সম্ভাব্য জরুরি বই বিআইডিএস কিংবা সিপিডির গবেষণাপত্র হিসেবেই কিয়ামত তক ঘুমিয়ে থাকতো নানান দস্তাবেজের মাঝে। সত্যি বলতে কী, এই বইটা পঁচিশ বছর আগে পড়া থাকলে কোনো কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়তো অন্য রকম নিতাম, হয়তো অন্য রকম ভাবতাম। এই গবেষণাটিতে তুলনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের আরেকটা গবেষণাকে, আজকের নতুন গবেষক চাইলে সেই দুটোকেই তাদের নতুন গবেষণার ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের দশকওয়ারী তুলনামূলক অগ্রগতি বুঝবার কাজে। এমনি বহু গবেষণাকর্ম আসলে এখনও ঘুমিয়ে থাকে গবেষণাসংস্থার দেরাজে, কেননা মহিউদ্দিন আহমেদ একজনই ছিলেন, সকল পাণ্ডলিপি নিয়ে কাজ করা একার পক্ষে সম্ভব না। এমন আর পাঁচ জন থাকলে আরও অজস্র গবেষণাগ্রন্থ আমরা হাতে পেতাম, গ্রন্থাগারগুলোকে এতটা শূন্য মনে হতো না।
নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সটি প্রেসের সাথে যুক্ততা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তার চোখ খুলে দিতে সাহায্য করেছিল। সকল বিষয়ে একজন প্রকাশক বিশেষজ্ঞ হবেন না, কিন্তু তাকে অন্তত সম্ভাবনাময় গবেষক ও গবেষণাকর্মগুলোকে চিনবার মতো দক্ষতা থাকতে হবে, থাকতে হবে তেমন সহকর্মীও। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভ্যান সেনডেল বা জয়া চ্যাটার্জির মতো উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই যে একজন প্রকাশকের সাথে নিত্য সংস্পর্শে ছিলেন, তিনি মহিউদ্দিন আহমেদ।
এই বইগুলো প্রকাশের পরিণতি সর্বদা আরামদায়ক ছিল না। ইউপিএল-এর বহু প্রয়োজনীয় গবেষণাগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি। এদের কোনো কোনোটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে লেখকের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। অনেকগুলোতেই মহিউদ্দিন আহমেদ নিজেই ঝুঁকিটা নিয়েছেন। হিউ ব্রামারের প্রসঙ্গেই রানা আব্বাসের পূর্বোক্ত লেখা থেকে আবারো উদ্ধৃত করা যাক: ‘তবে বইয়ের প্রকাশের কাজটা ছিল ব্যয়সাপেক্ষ। সেটি কলেবরের কারণেই। বইগুলোর বিক্রির সম্ভাবনা ছিল অনিশ্চিত। তবু কেন এ ব্যয়বহুল বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত? মহিউদ্দিন আহমেদের যুক্তি ছিল, ব্রামার যা করছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ কৃষি খাতের জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে। গবেষকদের জন্যও এমন বই হাতে পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার। সরকারে যাঁরা এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁদেরও বইগুলো কাজে আসবে।’
বাংলাদেশে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে শাহাদত চৌধুরী যেমন, প্রকাশক হিসেবে আরও বড় স্থানে, কিংবা একক স্থানে মহিউদ্দিন আহমেদ। বাকি সকল প্রকাশক কম কিংবা বেশি বাণিজ্যিকভাবে সফল বা ব্যর্থ, পাঠককে বিনোদন দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি তারা পালন করে আসছেন, এর বাইরে তাদের নিয়ে বলবার তেমন কিছু নেই। মহিউদ্দিন আহমেদকে সেই জায়গা থেকে মাপাই যাবে না। তিনি আসলে এমন ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেছেন– গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ, এবং প্রধানত বাংলাদেশ নিয়ে করা গবেষণা কর্মকে বই আকারে প্রকাশ– সেই স্থানে তিনি একক এবং অনন্য। শাহাদত চৌধুরীর কথা কেন তুললাম! ৮০ ও ৯০ দশকে তাঁর করা ঈদ সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে দেখবেন, নিশ্চিতভাবেই জনপ্রিয় হবে এমন সব দুর্দান্ত লেখা, যেমন মেকওলের লেখা ক্লাইভের জীবনীর অনুবাদের পাশাপাশি নিশ্চিতভাবেই পাঠক আদৌ খাবে না, তেমনি একটা প্রবন্ধ বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্বপাকিস্তান যুবলীগ’ হয়তো ছেপে ফেলবেন তিনি। এইখানেই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বশীলতা, তিনি পুরোটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হবেন না, সমাজের প্রতি দায় থেকেও কাজ করবেন। পাঠক তৈরি করা সম্পাদকের কাজ, পাঠককে হাত ধরে এগিয়ে নেয়া সম্পাদকের কাজ। দেখবেন, পাঠক খায় না এই রকম গবেষণালদ্ধ ফলাফলের অজুহাতে বাংলাদেশে সাহিত্য পাতাগুলো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বলি, এই গবেষণাটা করেছে কে বা কারা? জীবনে সাহিত্যের ধারেকাছে দিয়ে না হাঁটা লগ্নিবিদ্যার ছাত্ররা? অজস্র যে সদ্য তরুণ এই সাহিত্যপাতাগুলোর মাধ্যমে অন্তত খানিকটা সাহায্য পান সাহিত্য করতে বা সাহিত্য রুচি গড়ে তুলতে গবেষণার ইশারা পান, তাদের সাথে কি এই লগ্নিবিদ্যার শিক্ষার্থীদের পরিচয় আছে? বরং এই সাহিত্যপাতা গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়া পাঠকের সাথে দৈনিকের একটা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে, যে অভাব বিনোদন পাতা পূরণ করতে সক্ষম নয়। অন্যদিকে নিশ্চিত লোকসানের মুখেও মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন ব্রামার এর বই নিয়ে: ‘বইগুলো কাজে আসবে।’
৩.
গবেষণাগ্রন্থ কাজে লাগে, কিন্তু প্রায়ই তার বাণিজ্যিক মূল্য নাই, লোকসানী কারবার। ফলে মহিউদ্দিন আহমেদকে নানান রকম অভিযোজনের নীতিতে যেতে হয়েছে। আকবর আলী খানের ‘ডিসকভারী অব বাংলাদেশ’ ছাপতে সাহসের প্রয়োজন হয় না, যে কোনো জহুরী প্রকাশকই বুঝবেন এটা বাণিজ্যিকভাবেই সফল হবে। কিন্তু লীলা রশিদের ‘ইনস্টিটিউশনালাইজিং মাইক্রোফিনান্স ইন বাংলাদেশ’ ছাপাটা সম্ভব হবে এভাবে, যদিও বইটা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ? প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যালোচনামূলক সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান ও আরও নানা বিষয়ক গবেষণামূলক গ্রন্থাদি পাঠ্য হলে, বা পাঠ করাটা শিক্ষাজীবনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হলে এই বইগুলোর দ্বিতীয়বারের প্রকাশ নিয়ে ভাবতে হতো না। ধীরগতিতে হলেও সেগুলো চলে যেতো। সেটা হচ্ছে কী?
অন্যদিকে, দুনিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রে গ্রন্থাগারগুলো যে পরিমাণ বইপত্র কেনে, সেটাই থাকে প্রকাশকদের প্রধান আয়ের উৎস। ফলে সাধারণ আমপাঠকের জন্য তারা সুলভ সংস্করণ চাইলেই করতে পারেন। বাংলাদেশে এই আশা কি কোনো সুস্থ স্বাভাবিক প্রকাশক করতে পারেন? বাংলাদেশের যে কোনো গণগ্রন্থাগারের তাকগুলোর দিকে তাকালে সেগুলোতে বই নয়, মোসাহেবীপনার জ্বলন্ত স্বাক্ষরগুলো থরে থরে সাজানো দেখা যাবে।
শিশু একাডেমির গ্রন্থাগারে গেলাম চার বছর আগে শেষবার, আশির (বা হয়তো নব্বই) দশক পর্যন্ত কিছু ভালো বইপত্র সংগ্রহে আছে, তারপর পতন। মহিউদ্দিন আহমেদের সেরা সময়টাতে, ৮০’র দশকের স্বৈরাচারি আমলেও গণগ্রন্থাগারগুলোর দশা এখনকার চাইতে স্বাস্থ্যকর ছিল, যদিও তাও প্রকাশনা শিল্পের জন্য যথেষ্ট ছিল না। সম্ভবত এই কারণেই ইউপিএল তার অস্তিত্ব রক্ষার কৌশলে গুরুত্ব দিয়েছিল গবেষণা সংস্থা ও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে, যাদের গবেষণা, তারা নিজেরাই একটা বড় অংশ কিনে নিয়েছে। এভাবেই ইউপিএল অস্তিত্ব রক্ষা করেছে।
এত দুর্মূল্য বই সাধারণ পাঠকের কেনা দুষ্কর, সত্যি। বাংলাদেশে টাকার হিসেবে বই খুব সস্তা, কিন্তু মানুষের গড় আয়ের হিসেবে যদি বিবেচনা করেন, পৃথিবীর মাঝে হয়তো তা দুর্মূল্য। কিন্তু এরপরও পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারলে টিকে থাকার রসদ আরও খানিকটা মিলতো, তাতেও তো সন্দেহ নাই। অন্তত ব্রামারের বইগুলো, অন্তত গ্রামীণ সমাজ নিয়ে ইউপিএল-এর আর সব গবেষণাগ্রন্থগুলো– ‘ঝগড়াপুর রিভিডিটেড’ কি দশ বছর সময় নিতো সংস্করণ ফুরোতে! আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের কোনো বইয়ের দোকানে ব্রামারের কোনো বই পাবেন না, যেমন পাবেন না অধিকাংশ ‘অজনপ্রিয়’ গবেষণাগ্রন্থই। অথচ তার বাংলাদেশ: ল্যান্ডস্কেপ, সয়েল ফার্টিলিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ গ্রন্থটির অন্তত পাঠক-নন্দিত হবার সম্ভাবনা ছিল। অন্য আর একটা বইয়ের বেলাতে সাম্প্রতিক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি, একজন লেখক যৌক্তিক বিরক্তি নিয়েই একদিন জানালেন, তার রচিত ‘গণিত আমাদের কী কাজে লাগে’ বইটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিছু সংখ্যায় কিনতে চেয়েছিল শিক্ষার্থীদের উপহার দেয়ার জন্য, ঢাকার কোনো দোকানে সেটি পাওয়া যায়নি। আনু মুহাম্মদের মতো পাঠকপ্রিয় অর্থনীতিবিদের বইও ঢাকার অধিকাংশ দোকানে মেলে না। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, রীতিমত জনপ্রিয় ধাঁচের বই প্রকাশ করেন, এমন একজন সহপ্রকাশক একদিন দুঃখ করেই বললেন, কলকাতার প্রকাশকরা নিশ্চিন্তে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, ঢাকার দোকানগুলোতে তাদের সব বই মেলে, ঢাকায় বসে আমরা ঢাকার প্রকাশকরা তো এই কথাটা সাহস করে বলতে পারি না! এই কথাটি আহমদ ছফা প্রমাণ করেছিলেন শওকত ওসমানের একটা গালির জবাবে স্বয়ং তাকে নিউমার্কেটে নিয়ে যেয়ে, ‘এরপর একদিন আমি শওকত ওসমানকে সাথে নিয়ে ঢাকার নিউ মার্কেটে গেলাম। নিউ মার্কেটের সব বইয়ের দোকানে শওকত ওসমানের বই চাইলাম, কিন্তু কোনো বইয়ের দোকানই শওকত ওসমানের কোনো বই দিতে পারে না। কিন্তু যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই চাইলাম, দেখা গেল মুদির দোকানও তা দিতে পারে। শেষে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, সুনীল আপনার বড় না ছোট? তিনি বললেন, ছোট, অনেক ছোট। ওকে আমি জন্মাতে দেখেছি। আর জানবেন শওকত ওসমান লেখক হিসেবে ছোট লেখক নন, তবে অনেক লেখা আছে উৎকর্ষের বিচারে যা বেশ ভালো। এই অবস্থা দেখে আমি শওকত ওসমানকে বললাম, দেশটা কি আমরা ***ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?’ [আহমদ ছফা/আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারসমগ্র]
জ্ঞানের দুয়ার রুদ্ধ করার কিছু নাই, অন্যদিকে ঢাকার জ্ঞানভিত্তিক বইয়ের বাজারে বিদেশী বইয়ের একটা আধিপত্য নানা সঙ্গত কারণেই ছিল। কিন্তু ক্রমশ সকল উৎস শুকিয়ে আসার গত বিশ বছরের বাস্তবতায় মহিউদ্দিন আহমেদের ওই অভিযোজন নীতিও ভবিষ্যতে আদৌ আর কাজ করবে কি না, এই সামান্য রসদ দিয়ে ইউপিএল-এর মতো মহীরূহ প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকতে পারবে কি না, বলা মুশকিল। কেননা অর্থনীতি সমর্থন না করলে, সময় সমর্থন না করলে যে কোনো ব্যক্তিগত অভিযানই ডন কিহোতের মতো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, লক্ষ্য থাকুক যতই মহৎ। এই প্রসঙ্গেই অন্য একটি বিষয়ও আসে, গ্রন্থের মান ও উৎকর্ষ যে দেশে সরকারি ক্রয়ে ঠাঁই পাবার বেলায় একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, সেখানে নীতি বিসর্জন না দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রাম এত জটিল ও কষ্টসাধ্য, এত শ্রান্তিকর হবার কথা যে ধরেই নেয়া যায়, এই প্রতিকূল যুদ্ধটা না করতে হলে আরও অজস্র গবেষণা কর্মকে আমরা মহিউদ্দিন আহমেদদের মতো প্রকাশকদের হাতে গ্রন্থাকারেই দেখতে পেতাম। তিনি এমন গ্রন্থের একক ব্যতিক্রম হতেন না, তার অজস্র সহপ্রকাশক থাকতেন।
৪.
বইয়ের অত্যাধিক দাম, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাঠকের মতামত এই। এই বক্তব্যের ন্যায্যতা আছে, পাঠক হিসেবে আমিও তাই মনে করি। কিন্তু ওদিকে হিউ ব্রামারকে যিনি চিনতে পারেন, এমন একজন সম্ভাব্য প্রকাশক যদি এই চিনবার যোগ্যতার সুবাদে দিনদিন নিঃস্ব হতে থাকেন আর্থিক দিক দিয়ে, তাহলে ভবিষ্যতের অন্যান্য সম্ভাব্য মহিউদ্দিন আহমেদের কী গতি হবে? নতুন মহিউদ্দিনরা কি হাঁটবেন এই রাস্তায়? উত্তর পেতে হিউ ব্রামারের বইগুলো বিক্রি হলো কেমন, সেই দিকেই একবার তাকাই। হাতের কাছে তার যে দুটো বই দেখতে পাচ্ছি, একটা আমার প্রিয় বইগুলোর মাঝে শীর্ষে, ‘বাংলাদেশ: ল্যান্ডস্কেপ, ফার্টিলিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। এখনো সেটি শেষ হয়নি, অর্থাৎ গুদাম ভাড়া, মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ইতিমধ্যেই এটি বিপুল লোকসান দিয়েছে। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ, সি লেভেল রাইজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’-এর প্রথম প্রকাশ ২০১৪ সালে, ২০১৯ সালে এটির দ্বিতীয় মুদ্রণ এসেছে। অর্থাৎ এটিও ব্যবসা সফল নয়। ব্রামারের আটটি বা নয়টি গ্রন্থ ইউপিএল প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা বর্ণনা করতে গেলে ইউপিএল প্রকাশিত এরিক কে জনসনের একটি গ্রন্থের কথা মনে পড়ছে, শিরোনামটা যদিও মনে আসছে না। সেখানে এই ভদ্রলোক আরও অনেক কিছুর সাথে ৭০-৮০ দশকের বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, সীমিত সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা সংগ্রাম। এটা গ্রামীণ মাতব্বর, ব্যবসায়ী, জমির মালিক, বর্গাদার, দিনমজুর, ভূমিহীন সকলের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্কের কাঠামো নির্ধারণ করে। সত্যি বলতে কি, আমার দেখা ৯০ দশক পর্যন্ত গ্রামসমাজকে ব্যাখ্যার অন্যতম একটা সূত্র হতে পারে জনসনের এই ব্যাখ্যার পাটাতন। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প কিন্তু আজও প্রায় সেই দশায় আছে। প্রকাশক-প্রকাশক, লেখক-প্রকাশক, রাষ্ট্র-প্রকাশক, পাঠক-প্রকাশক, দোকানদার-প্রকাশক সকল ক্ষেত্রেই একজন খলনায়কের নাম প্রকাশক। কারণ প্রকাশনা তার প্রধান জীবিকা। বাকিদের আংশিক। প্রকাশনা নামক ঘটনার কেন্দ্রে থাকেন প্রকাশক এবং সম্পদের সীমিত দশা তার আচরণকেও সংকুচিত, বলতে দ্বিধা নেই ক্ষেত্রবিশেষে চালাকিপূর্ণ এবং শঠ ভাবর্মূর্তিও দেয়। এর মাঝে দুর্নীতিগ্রস্ত হঠাৎ প্রকাশকরা বিপুল টাকা ছড়িয়ে বাজার এলোমেলো করে দেন, নোট বইয়ের প্রকাশকরা টাকার থলে ছড়িয়ে খাঁটি প্রকাশকদের আরেক দফা বিপন্ন করেন। কিন্তু এটাও তো সত্যি কথা, লেখকদের বই রচনা বাবদ আরও বহুগুণ অর্থ পাওনা ছিল।
মহিউদ্দিন আহমেদের জন্য এই বিষয়টা আরও জটিল ছিল। তিনি জনপ্রিয় ধাঁচের সাহিত্য বইয়ের প্রকাশকে লক্ষ্য হিসেবে নেননি, অন্যদিকে স্পষ্টবাদী ও একরোখা চরিত্রের এই মানুষটি নীতি বিসর্জনও কোনোকালে দেননি। প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার নিশ্চিত করা, এবং সেই কাজ করতে গিয়ে লেখককেও কখনো বঞ্চিত না করাটাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা– অসম্ভব একটা কাজের চেষ্টাই তিনি করেছেন। বহু অনভিজ্ঞ মানুষ দূর থেকে বলে থাকেন, বই তো আলু-পটলের মতো পণ্য নয়। মহিউদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন, বই আলু-পটলের মতোই, এবং আরও গুরুভার পণ্য। এই খাতে রক্তপ্রবাহ যথাযথ থাকলে সেটা শুধু প্রকাশক-লেখক-মুদ্রাকর-শিল্পী ইত্যাদির জন্য ভালো না, জাতির জন্যই মঙ্গলজনক। কোনো দেশে শুধু পাঠকের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশনা শিল্প দাঁড়ায় না, সেটা দাঁড়ায় রাষ্ট্রের ভর্তুকিতে, যেটা আসলে ভবিষ্যতের জন্য সামাজিক বিনিয়োগ। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায়ের এই লড়াইটা প্রকাশক একা করতে সক্ষম নন। তার সাথে লেখক-পাঠককে যুক্ত করা দরকার যাতে সরকার এমন নীতি গ্রহণে বাধ্য হয় যেখানে প্রকাশনা, অর্থাৎ জ্ঞান পাঠকের কাছে সুলভ থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশ সেই পথ থেকে ক্রমশ আরও দূরে সরে যাচ্ছে।
ফলে দেশের প্রকাশনা ক্রমশ মোসাহেবীতে আক্রান্ত, যার প্রধান লক্ষ্য সহজে সরকারি ক্রয়ে, মন্ত্রণালয়ের ক্রয়ে বই গছিয়ে দেয়া, কিংবা আরও নানা অসঙ্গত উপায়ে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রভাবশালীদের আত্মীয়দের লেখা অত্যন্ত ফালতু বই হাজারে হাজারে কিনতে বাধ্য করা। এমন অজস্র ঘটনা এখন নৈমত্তিক। যারা অতটা নীচে নামতে পারেন না, তারা এককভাবে জনপ্রিয় আরামদায়ক বই প্রকাশে মগ্ন। অন্তত এই দ্বিতীয় পথটিকে ভয়াবহ অনৈতিকতা নেই, এটুকু সত্যি। কিন্তু পাঠককে কি আমরা চিরকাল গোয়েন্দা গল্প আর অনুপ্রেরণামূলক বইয়ের পাঠক বানিয়ে রাখবো? আমাদের জাতির পাঠাভ্যাস চিরকাল কিশোর বয়েসে ঠেকে থাকবে? গবেষণামূলক গ্রন্থ, যার পাঠক সীমিত, তার কোনো বিকাশ বাংলাদেশে আর ঘটবে না? মহিউদ্দিন আহমেদ নেই, কিন্তু ভবিষ্যতের প্রকাশকদের এই্ গুরুতর প্রশ্নটার সমাধান ভাবতে হবে।
৫.
আগেই বলেছি, কখনো কোনো লেখককে বঞ্চিত না করাকে মহিউদ্দিন আহমেদ তার ন্যূনতম পেশাগত অবস্থান হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ না ছাপার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কখনো কখনো। কিন্তু সেই দায় প্রধানত পাণ্ডলিপি পর্যালোচনার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদেরই। শুধু দেশীয় লেখকদের নন, বিদেশী লেখকদেরও তিনি সর্বদা তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছেন। মহিউদ্দিন আহমেদ সম্ভবত পুরনো প্রকাশকদের মাঝে একমাত্র, যিনি কখনো বিনা অনুমতিতে কোনো বিদেশী গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করেননি। এই বিষয়ে যে আন্তর্জাতিক আইন আছে, দেশীয় আইন আছে, এবং তা মান্য করতে চেষ্টা করাটা সঙ্গত, সেটা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রকাশক এর আগে ভেবেছেন বা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন, তেমনটা মনে হয় না। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ত¡ আইনের কিছু অন্তর্নিহিত দার্শনিক দুর্বলতা আছে। জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য খুব সহায়ক নয় তা। যে কারণে ওষুধের ওপর মেধাস্বত্বের কড়াকড়ি ক্ষতিকর, কিন্তু একইসাথে তা অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজন নতুন আবিষ্কারের প্রণোদনা দেয়ার জন্য, একই কথা হয়তো গ্রন্থস্বত্তে¡র বেলাতেও প্রযোজ্য। ওষুধ এবং এমন জরুরি পণ্যগুলোর মতোই গ্রন্থের অনুবাদস্বত্ব পাবার জন্য প্রদেয় অর্থের পরিমাণ ন্যূনতম হওয়া উচিত। এগুলো আজকের প্রকাশকদের ভাবনার বিষয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্তরে তা জোরেশোরে তোলাটা দরকার। বাংলাদেশের প্রকাশনাকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাবারও বিপুল কৃতিত্বটি মহিউদ্দিন আহমেদের, তাঁর অনুপস্থিতিতে এই কথাগুলো তোলা যাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে? তাঁর সুনাম ও অর্জিত দক্ষতার গুণে খুব সহজেই তিনি ও তার প্রতিষ্ঠান বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের অনুবাদস্বত্ত¡ আদায় করতে পেরেছেন। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’-এর কথা, দেশভাগ নিয়ে বলা চলে হাল আমলের গবেষণাগ্রন্থ এটি।
কিন্তু প্রকাশক হিসেবে যে দ্বিতীয় গুণটির কথা মহিউদ্দিন আহমেদের বিষয়ে বলতে চেয়েছিলাম লেখার শুরুতেই, সেটা হলো গ্রন্থের সম্পাদনা। বাংলাদেশের লেখকদের একটা বড় অংশ প্রকাশকদের বাঁধাইকরের চাইতে বেশি কিছু ভাবেন না। তারা পাÐুলিপি এনে দেবেন, প্রকাশক সেটা ছেপে বাঁধাই করে দেবেন, এইটুকুই তাদের কাজ। এজন্য লেখকদের দোষ দেয়ার উপায়ও আসলে নেই। অন্যদিকে, পান্ডুলিপি প্রণয়নে প্রকাশকের কাছ থেকে যে সাহায্য ও পরামর্শ লেখকদের প্রাপ্য, সেটাও পুরনো প্রজন্মের খুব কম প্রকাশকই দিতে সক্ষম, নতুনদের মাঝেও হয়তো অল্প কয়েকজনই। মহিউদ্দিন আহমেদ একদম শুরু থেকে পান্ডলিপিগুলোকে পর্যালোচনা ও মতামতের জন্য বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী লেখককে পাণ্ডলিপির মানোন্নয়নের ফরমায়েশ করেছেন। পৃথিবীব্যাপী এটা খুব চলতি রীতি হলেও, এবং আইজ্যাক আসিমভের মতো মানুষও প্রকাশকের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে আসলেও বাংলাদেশে এই বিষয়টা বলা চলে অনুপস্থিতই ছিল মহিউদ্দিন আহমেদের আগে। বড়জোর বানান সম্পাদনা চলতো। একদিকে যেমন এটি তার প্রতিষ্ঠানটিকে আরও ব্যয়বহুলই করেছে। অন্যদিকে, এই ব্যয়টি না করে বহুক্ষেত্রেই একটি পাণ্ডলিপি গ্রন্থের আকৃতি পায় না, অনাবশ্যক ভারী কিংবা অসামাঞ্জস্যহীন অথবা বহু সঙ্গত প্রশ্নের উত্তরহীন থেকে যায়। একটা গবেষণামূলক বইয়ের দাম কেমন হওয়া উচিত, সেটা বিবেচনা করতে গেলে তাই প্রকাশকের মুনাফা, লেখকের সম্মানীর পাশাপাশি পাণ্ডলিপি উন্নয়নের খাতটিকেও যে বিবেচনায় রাখতে হবে সেটা মহিউদ্দিন আহমেদই শিখিয়েছেন। আমার তো মনে হয় একজন প্রকাশকের এমন আর্থিক সামর্থ্য থাকা উচিত যে, লাখ টাকা বেতন দিয়ে একজন জার্নাল পাঠককে পুষবেন যার কাজ হবে সম্ভাব্য পাণ্ডলিপি সেখান থেকে সন্ধান করা।
ইউপিএল-এর বইয়ের দাম অত্যধিক বেশি, আগেই বলেছি এই কথাটার সাথে একমত আমি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, এই দামটা আগে আরও বেশিই ছিল। আশির দশকে তাদের প্রকাশিত বহু জনপ্রিয় বইয়ের দাম দিয়ে তখনকার বাজারদরে দু’দুটো আস্ত ইলিশ মাছ কেনা সম্ভব হতো। বিশ্বাস হচ্ছে না? ফয়েজ আহমেদের ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র দ্বিতীয় পর্ব ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ বইটির দাম দেখুন, সম্ভবত ৬৬ টাকা। ১৯৮৮ সালে এই দিয়ে অন্তত দুই বা আড়াই কেজি গোমাংস কেনা যেতো। তখন ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র এক একটি সংস্করণ আড়াই হাজার করে প্রকাশিত হতো, ৯০-এর আগেই চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের বাজার ও নীতিবান প্রকাশকের পরিসর কতটুকু সংকুচিত হয়েছে, তা আশা করি বোঝা যাচ্ছে খানিকটা।
৬.
গবেষণার ভাষা বিষয়ে আমি একমত নই প্রকাশক মহিউদ্দিন আহমেদের চিন্তার সাথে। এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কখনো কিছু বলেননি, কিন্তু অনুমান করা যায় তার প্রকাশিত অধিকাংশ গবেষণাগ্রন্থের ভাষা ইংরেজি। বাংলায় অনুবাদের চেষ্টা করেননি হয়তো তেমন, হয়তো ভেবেছেন শিক্ষিত অংশ ইংরেজি এমনিতেই পড়তে পারে। ইংরেজি ভাষার প্রতি তাঁর দুর্বলতার দুটো সাক্ষ্যও দেখতে পাচ্ছি, অধ্যাপক তানজীম উদ্দীন খান এবং অধ্যাপক আলী রীয়াজ উভয়েই তাদের লেখায় প্রশংসা করেছেন বিষয়টির। আলী রীয়াজ প্রশ্ন করেছেন ‘বাংলাদেশে গবেষণা-ভিত্তিক ইংরেজি বইয়ের প্রকাশনার যে ধারা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তা কি অন্য আর কারও হাতে তৈরী হতে পারতো?’ তানজীম উদ্দীন খান লিখেছেন: ‘প্রথম পরিচয়ে জানতে চাইলেন আমরা ইংরেজিতে লেখা পাঠ্যবই পড়ি কিনা। কীভাবে তরুণ শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে পাঠোভ্যাস বাড়ানো যায়, শিক্ষকরা কী ভূমিকা রাখতে পারেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা।’
বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে গবেষণার ভাষা নির্ধারণের একটা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো, ধরে নেয়া হয় বাংলাভাষা জনপ্রিয় বিষয়াদিতে লেখবার ও বলবার জন্য, বড়জোর গবেষণার জনবোধ্য ভাষ্য হবে তাতে। গুরুতর জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা ইংরেজিতেই হবে। এই ঝোঁকটি বাংলাদেশের গবেষকক‚লের ছিল, এবং আছে। খেয়াল করলেই দেখবেন বাংলাদেশের বস্তুনিষ্ঠ পন্ডিতদের একটা বড় অংশ বাংলাতে লেখার পরিশ্রমটা করতেই চান না। এই বিষয়ে তাদের শরম দেয়টাই পাঠক হিসেবে কর্তব্য বিবেচনা করি। বরং বাংলাদেশের সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য যে বিপুল শ্রম ও অর্থ ইউপিএল ৮০ ও ৯০ দশকে ব্যয় করেছে, তাকে আমার পণ্ডশ্রম বলেই মনে হয়। এই মনোযোগ ও অর্থ দিয়ে আরও বহু ইংরেজি বই বাংলায় তর্জমা করা যেতো।
প্রকাশকদের জন্য আর একটা বিব্রতকর প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো, বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে তাদের আন্তর্জাতিক প্রকাশনার জন্য বিবেচনা না করা। উপনিবেশিক মুগ্ধতার এই বোধের কারণে গবেষক/লেখকের সাথে প্রকাশকের যৌথতায় দেশীয় প্রকাশনা শিল্পটি যে দুনিয়ার অঙ্গনে আরও বেশি জায়গা করে নিতে পারতো, সেই ছাড়টুকু এই লেখকরা বহুক্ষেত্রে দিতে অক্ষম। এই সঙ্কটের মাঝেও যুদ্ধ করে মহিউদ্দিন আহমেদ বরং ক্লারেন্স মেলোনি, তেরেশ ব্লঁশে, ব্রামার, ভ্যান শেনডেলের মতো বিদেশী লেখকদের ইউপিএল-এর লেখকে পরিণত করতে পেরেছেন, বাংলাদেশের কারও কারও কাছ থেকে তা পাননি। একইসাথে এটুকু বলে রাখা ভালো যে, তিনি শুধু গবেষণাগ্রন্থকেই একমাত্র গুরুত্ব দেননি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বা শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর প্রকাশকও ইউপিএল।
৭.
শেষ করা যাক অধ্যাপক আলী রীয়াজের একটা স্মৃতিচারণ থেকে “মহিউদ্দিন ভাই ১৯৯৭/৮ সালে লন্ডনে আমাকে তাঁর জীবনের এই পর্বের কথা বললে আমার স্বতস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিলো যে– ভাগ্যিস আপনি পিএইচডি না করে ওইউপি’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল মুখে বলেছিলেন– ‘আমিও তাই ভাবি’।” আমরাও তাই ভাবি। মহিউদ্দিন আহমেদ ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ বলে একটা শব্দবন্ধ নির্মাণ করেছিলেন। সেটা নির্মাণের মহা পাগলামিতে কেউ যদি শরিক হতে চান, এবং সেই জন্য পিএইচডি, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা কিংবা অন্য আর যে কোনো তেজারতি ত্যাগ করার সাহস দেখাতে চান, তার জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাজ হবে মহিউদ্দিন আহমেদের প্রয়াণের সময়টিতে বাংলাদেশের গবেষণামূলক গ্রন্থাদি প্রকাশ অব্যাহত রাখতে গেলে– অব্যাহত রাখলে আসলে লাভটা কী? আমরা তাতে বড়জোর আগের মতোই নিন্দনীয় দশায় থাকবো, বরং সাহস করে বলা উচিত প্রকাশনাকে এগিয়ে নিতে হলে– যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এই মুহূর্তে হয়েছে, তার জবাবও খুঁজে বের করা। নতুন অভিযোজনের কৌশল নিয়েই নীতিতে অচল থাকবে হবে। মহিউদ্দিন আহমেদর জীবনী লেখার চেষ্টা এখানে করিনি, যদিও সেটি কম রোমাঞ্চকর নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্র ছিলেন, ছিলেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র সংসদের নেতা, ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনীর মতো সংস্থার দায়িত্বে। যারা বিস্তারিত জানতে চান, তারা ইউপিএল-এর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া এই লেখাটি পড়তে পারেন। এছাড়াও পড়তে পারেন অধ্যাপক আলী রীয়াজের চমৎকার স্মৃতিচারণটি ।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত পোর্ট্রেট : মাসুক হেলাল-এর আঁকা
© দিন পরিবর্তন