logo

ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস ও পেছনের কথা

দিন পরিবর্তন ডেস্ক

Published:22 Nov 2023, 05:49 PM

ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস ও পেছনের কথা


ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত ইতিহাস, ইসরাইল সৃষ্টির ধারাবাহিক তথ্যকথা, তৎকালীন বিশ্ব শক্তিগুলোর বহুমুখী অপতৎপরতা ও বিশে্বর বিভিন্ন গণহত্যার চিত্র তুলে ধরে লেখা হয়েছে এক গবেষণামূলক নিবন্ধ। চার পর্বে ছাপা হবে এ নিবন্ধ। আজ তুলে ধরা হলো এর প্রথম পর্ব। লিখেছেন- গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

ফিলিস্তিন নামটি মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি মানুষের মনে এক রক্তাক্ত ভূমি, অবৈধ ইসরাইলিদের কালো থাবায় নিষ্পেষিত প্রতিটি হৃদ, শিশুদের সাহসের স্পর্ধা দেখলে মনে ভয়ের স্ফুলিঙ্গ রেখাপাত করে, তৃতীয় সারির মুসলমানদের, হিংস্র ইসরাইলীদের প্রতিনিয়ত হামলা লাশের বুকে দাঁড়িয়ে হাসি- এ কেমন নৃত্য, যা দেখলেন মনে হয় ইহুদীবাদরাই এমন কর্ম করতে পারে, ফিলিস্তিনি সেই ভাইয়ের মুচকি হাসি আজও পৃথিবীর বুক ধারণ করে রেখেছে, ইসরাইলী আদালত যখন তাকে দু’শ বছরের কারাদÐ দিল, সে হেসে আনন্দ চিত্তে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইসরাইলী বিচারককে বলেন, হায়! হায়!! আপনি কি মনে করেন, ইসরাইল আরো দু’শ বছর পৃথিবীর মানচিত্রে থাকবে? এ কেমন প্রশ্ন! এ কেমন দুঃসাহস!!
আজও সেই ছোট ভাইটির কথা মনে পড়ে, যে বলেছিল আমিতো মরে যাব, কিন্তু আল্লাহর কাছে তাদের (সৌদি আরব) ব্যাপারে অবশ্যই বিচার দায়ের করব, কি ধরণের ক্ষোভ, কেমন বিদ্বেষী মনোভাব। ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত অকালেই বিধবা, জন্মের পূর্বেই বাবার চলে যাওয়া, মায়ের জঠরে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসার আগেই চলে যাওয়া শিশু, ভাইয়ের কোলে ভাইয়ের লাশ আবার মুক্তি ¯েøাগানের সারিতে, পৃথিবীর শ্রেষ্ট সম্পদ ছেলের লাশ ফেলে তাগুতি ইহুদীবাদের উপর মায়ের প্রতিবাদ, অপ্রাপ্ত কন্যার বিবাহের আহাজারি যেন তার সন্তান হয়ে ফিলিস্তিন মুক্তির আন্দোলনে শরিক হতে পারে, এ কেমন দাবি!
এসকল বিষয় ফিলিস্তিনিদের কাছে যেন এক নিত্য নতুন বিষয়, যদিও আমাদের কাছে এই কথাগুলো,এক অচিন স্বপ্নপুরির কথা, কেননা আজ আমরা মানব জীবনে বিলাসিতার চাদর খুলে সর্বোচ্চ আয়েশে ব্যস্ত, আরব ভূখন্ডের রাজাদের আতর ব্যবহারে কয়েক কোটি বাজেটের সুন্নত পালনের স্পর্ধা, তাদের জীবন চরিত্রের কিছুই এখানে উল্লেখ করতে চাই না। শুধু ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ইতিহাস কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের আকাশে আসে কালো মেঘের ডাক, কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের ওসমানীয় খেলাফতের অধীনে এক শান্ত আদর্শীয় আকর্ষণে অভয়ারণ্য এক ভূখন্ড। যার মানচিত্রের আবরণ ছিল শ্যামল আর ফসলাদি যেন আল্লাহর নেয়ামতের এক জ্বলন্ত দানের প্রতিমার স্তুপ ছিল, আজকের যুদ্ধবাজ ফিলিস্তিনের বাসিন্দারাও দৈহিক সৌন্দর্য ও কমনীয়তার প্রতীক। আয়তন দশ হাজার চার’শ ঊনত্রিশ বর্গমাইল। (১০,৪২৯) মধ্যপ্রাচ্যের ‘উর্বর চন্দ্র’ (ঋবৎঃরষব ঈৎবংপবহঃ) নামে খ্যাত এলাকার উত্তরে ফিলিস্তিন। পশ্চিম এশিয়ার একবারেই পশ্চিম অঞ্চল থেকেই প্রধান তিনটি দলের সূচনা হয়।
ফিলিস্তিন যার মধ্যে ছিল ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম, ফিলিস্তিন ভূখন্ডের নিকটবর্তী হিজায হতে ইসলামের আবির্ভাব। ফিলিস্তিন প্রথম মুসলমানদের হস্তগত হয় হযরত ওমর ফারুকের খেলাফতকালে ১৮ হিজরিতে। ক্রুসেডের আক্রোশি থাবায় ফের করাত্ব বরণ করে ১০৯৬ সালে। ফিলিস্তিন, দীর্ঘ ৯০ বছর থাকে খ্রিস্টানদের কালো আঁচলে, পথ পরিক্রমায় ফের ফিলিস্তিন বন্ধীত্বের গানি থেকে মুক্তি পেয়ে হেসেছিল, মুসলিম মিল্লাতের বীর সিপাহী কালজয়ী সালাহউদ্দীন আইয়ুবির মাধ্যমে। এর পর ফিলিস্তিন ১৯১৭ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলমানদের আধিপত্যই ছিল। যার সংখ্যা গত মান দাঁড় করালে প্রায় ১২৫০ বছর মুসলমানদের অধীনেই ছিল ফিলিস্তিন ভ‚মি।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই ইঙ্গ মার্কিনিদের মদদে ফিলিস্তিন ভূখন্ডের ইহুদীরা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকলে এক পর্যায় ফিলিস্তিন বাসিদের উৎখাত করে সেখানে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করে। এই রাষ্ট্র কায়েমের পিছনে অনেক দিনের সূ²দর্শী প্রতারণার আশ্রয়ে স্বপ্নময়ী ছিল ইহুদীরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু দিন আগে কর্নেল লরেন্স দৃশ্যত মুসলমান হয়ে আরবদের প্রতারিত করে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তোলে ও প্রচারণা চালায়। আরব তরুণরা তার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে যায়। ফল দাঁড়ায় তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ মরক্কোর সমুদ্রবন্দর  কাসাব্ঙ্কালয় হামলা চালায়। সেখানে ছিল তুর্কি যুদ্ধজাহাজ। ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে ৬০০ সৈন্য ছিল। তুর্কি মোকাবেলায় ব্রিটিশ জাহাজ ডুবে যায়। ঘটে যায় এক করুণ ইতিহাস, মরক্কো তখন তুর্কি খেলাফত থেকে আলাদা হয়ে যায়। ইতিহাস বলে ১৯১১-এ তুর্কি খেলাফত এক এক করে মরক্কো, সেনেগাল, আলজিরিয়া, তিউনিস, লিবিয়া, মিসর, সুদান, মধ্য আফ্রিকা ও অন্য সব আফ্রিকান প্রদেশ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। কিন্তু মধ্য প্রাচ্যে ও এশিয়ার প্রদেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব রাখতে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদের প্রচারণা চালানোর কারণে মরক্কো থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিদ্রোহ দেখা দেয়।
অন্যভাবে বলা যায়, আটলান্টিক থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত আরব জাতীয়তাবাদের ঢেউ চলতে থাকে। তুর্কি খলিফারা আরবদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা চালান এবং যুদ্ধে তুর্কিদের পক্ষে কাজ করতে অনুরোধ জানান। যুদ্ধের পর আরবদের স্বাধীনতা কিংবা ক্ষমতার ভাগ দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আরবরা কিছুতেই শান্ত হয়নি। আফ্রিকার প্রদেশগুলো হাতছাড়া হয়ে গেলেও ইয়েমেন, আরব, ইরাক, সিরিয়া ও ফিলিস্তিন অর্থাৎ এশিয়ার এসব অঞ্চল তুর্কিরা ছাড়তে রাজি ছিল না। ফলে এখানে তুমুল লড়াই হয়। ত্রিপক্ষীয় শক্তি একজোট হয় তুর্কিদের বিরুদ্ধে এক দিকে ব্রিটিশ, আরেক দিকে ফরাসি আর অপর দিকে আরব শক্তি সম্মিলিতভাবে তুর্কি শক্তির মোকাবেলা করতে থাকে।
তুরস্কের ওসমানি খেলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। আরবরা তখন ব্রিটিশ ও ফরাসি সৈন্যদের চলে যেতে বলল। কিন্তু তারা যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে না নেয়া পর্যন্ত চলে যেতে অস্বীকার করল। ইউরোপীয় বাহিনী এভাবে জবরদখলকারী হিসেবে রয়ে গেল। এখন আরবরা না পারে সইতে, না পারে কিছু বলতে। অবশ্য প্রতিবাদ ও সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। ওদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত গোষ্ঠীও তৈরি হয়ে যায়। তাদেরই হাতে এক সময়ে এসব অঞ্চলের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে দখলদার বাহিনী আস্তে আস্তে চলে যায়। তবে এজন্য স্থানীয় জনগণের ত্যাগ ও সংগ্রাম চালাতে হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। সিরিয়া ৩৫ বছর পর স্বাধীনতা লাভ করলেও দখলদার শক্তি এটাকে ভাগ করে সিরিয়া ও লেবানন দু’টি রাষ্ট্রে পরিণত করে। কোনো কোনো অঞ্চল চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের রক্তক্ষয়ী ত্যাগ স্বীকারের পর স্বাধীন হয়। ফ্রান্স বলে বসে আলজিরিয়া আমাদেরই দক্ষিণ অংশ। আমরা তা ছাড়ব না। ফ্রান্সের জবর দখলের প্রতিবাদে গড়ে ওঠে গেরিলা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আহমদ বেনবিল্লাহ। শুরু হয় সব শহর ও গ্রামে গেরিলা যুদ্ধ । ফলে ৭৫ বছর পর শেষ পর্যন্ত প্রচÐ লড়াই ও বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে আলজিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কালে (১৯১৪-১৯১৯) ফিলিস্তিন ভূখন্ডের থাকে কয়েক হাজার ইহুদী তাদের প্রায়ই ছিলেন নিজ রূপে ব্যবসায়ী, আর বিশাল সমাহার ছিল মুসলমান, এদের মধ্যে ছিল উচ্চবিত্ত জমিদার, কৃষক, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকুরে, বিশাল জলপাই বাগানের মালিক, কারখানা মালিক ইত্যাদি।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর আদম শুমারি অনুযায়ী ফিলিস্তিনে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখ। জীবন ছিল তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্বিঘেœ সচ্ছল ও ছিল প্রতিটি মুসলিম অন্তর। কে জানত ভবিষ্যৎ হবে ওদের জন্য এক কংকাল কংক্রিটের, আঘাত করবে দরিদ্রতার গøানি, শরণার্থী শিবিরের পরিচয়ে পৃথিবী চিনবে ওদের।
কলঙ্কিত জাতি ইহুদীরা তখন ব্রিটেন রাজার সাথে চুক্তি করে, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সব ব্যয় বহন করে তা প্রতিশোধ করবে। যদি ব্রিটেন তাদের কাংখিত ইহুদীবাদের একটি রাষ্ট্র গঠন করে দেয়, চুক্তিটি করে ২ নভেম্বর ১৯১৭, বৃটেনের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোর এ উপলক্ষ্যে যে ঘোষণা দেন এরই নাম বেলফোর ঘোষণা। যেহেতু তখন ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণেই ছিল ফিলিস্তিন ভ‚খÐটি,তাই কৌশলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ইহুদীদের পরামর্শ দেয় তারা যেন ইউরোপ থেকে অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে ফিলিস্তিনে, এ যেন আগাম কোন কালো মেঘের ডাক। ১৯১৮ পর্যন্ত ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজারে। কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যা থাকে সেই ৭ লাখেই।
ইহুদিরা পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও বাল্টিক এলাকাগুলো থেকে আসতে থাকে এবং ফিলিস্তিনে তাদের বসতি করে দিতে থাকে ব্রিটেন। ১৯২৭ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের ছোট বড় ২২০ বসতি গড়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন তাদের সুদূরপ্রসারী কালো পথ চলনে হাইফা থেকে জাফা এলাকা পর্যন্ত এসব বস্তি নির্মাণ করে, তার ফলে প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ করে ইহুদি আসতে থাকে ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে লিগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেট ছিল। সে মতে ব্রিটিশ সরকার ইহুদিদের ন্যায়-অন্যায় সব রকমের সুবিধা দিতে থাকে এবং আরবদের উপক‚লীয় এলাকা থেকে জেরুজালেমের দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
স্বল্প পথ চলনে ফিলিস্তিনে ১৯৩১ পর্যন্ত জনসংখ্যার হার দাঁড়ায় এ রকম নিরেট আরব মুসলমান সাড়ে ৭ লাখ বা শতকরা ৭৩ ভাগ, ইহুদি পৌনে ২ লাখ বা ১৭ শতাংশ, খ্রিষ্টান ৯১ হাজার বা ৯ শতাংশ অন্যান্য ৯ হাজার বা ১ শতাংশ। প্রথম দিকে অনেক নবাগত গোষ্ঠী আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে, আবার অনেকেই অনাবাদী জমি বিনামূল্য দখল করে বসতি স্থাপন করে, ইংরেজরা তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতার বলয়ে কিছু জমি অ্যাকোয়ার করে ইহুদিদের বসতি স্থাপন করে দেয়, অবশেষে সেই কালো তারিখ যা ছিল ১৪ মে ১৯৪৮ ইংরেজি।
দিখন্ডিত করে দেয় ফিলিস্তিনকে, ইহুদীদের জন্য বরাদ্দকৃত হয় কিছু অংশ, যার পরিমাণ হয় ৭ হাজার ৯৯৩ বর্গমাইল। আরবদের প্রতি অবিচার করে দেয়া হয় মাত্র ২ হাজার ৪৩৬ বর্গমাইল। সেই সিদ্ধান্তে ইহুদীরা তাদের প্রতারণা করে পাওয়া ভূখন্ড থেকে বের করে দিতে থাকে আরবদের, নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে আরবরা; তাদের ভ‚মি ইহুদীকরণ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আশ্রয় নেয় প্রতিবাদের। সেই প্রতিবাদ অবশেষে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিয়ে যায়।
[চলবে]
লেখক : ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও সংগঠক।



© দিন পরিবর্তন