দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:29 Jun 2022, 12:10 PM
বাংলার টুপির বিশ্বযাত্রার গল্প
মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে টুপির বাজার বছরজুড়ে। তারপরও ধর্মীয় রীতি ও দিবস পালন তথা হজ, রোজা ও ঈদের সময় টুপির চাহিদা বেড়ে যায়। তা ছাড়া বিশ্ববাজারেও বাংলার টুপির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। টুপির বাণিজ্য সুবাদে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের সুনাম। কেবল টুপি রফতানি করেই বছরে আয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। টুপি শিল্পের গোড়াপত্তন ফেনী জেলায় হলেও এ শিল্প ছড়িয়ে পড়ছে ভোলা, চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, ময়মনসিংহ, সিলেট, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। টুপি শিল্পের কল্যাণে ভিন্নধর্মী বিকল্প পেশার খোঁজ পেয়েছেন গ্রাম-বাংলার লাখো নারী। টুপির মান এবং ডিজাইন আকৃষ্ট করে বলেই হজের মৌসুমে সৌদি আরবে আগত হাজীরা বাংলাদেশের টুপি ক্রয় করেন। আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের হাজীরা বাংলাদেশি টুপি সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশি টুপি তুলনামূলক দামে সস্তা, বিক্রয়ে লাভ ভালো। রাজধানীর পুরান ঢাকার হরনাথ ঘোষ রোডে ‘আলিফ ক্যাপ গার্মেন্টস’-এর টুপি রফতানি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে। আলিফ টুপির কারখানায় ২৫০ শ্রমিক ও ছোট-বড় ৪০০ মেশিনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৬ লাখ টুপি তৈরি ও বিদেশে রফতানি করা হয়। তবে চাহিদা প্রায় ১২ লাখ টুপির।
শিল্পবন্ধন : মাস্কাট থেকে বাংলাদেশ
ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পূর্ব জয় নারায়ণপুর গ্রামের বেলায়েত হোসেন ১৯৮১ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে ওমানের রাজধানী মাস্কাটে পাড়ি জমান। সেখানকার পুরুষদের মাথায় সুন্দর নকশা করা টুপি দেখে তারও টুপি বানানোর ইচ্ছে জাগে। টুপি তৈরির কৌশল অনুসন্ধানে বেলায়েত একদিন মাস্কাট থেকে ওমানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সালালায় যান। সেখানে নকশি টুপি কারখানায় এক পাকিস্তানি নাগরিকের সহকারী হিসেবে ছয় মাস কাজ শেখেন তিনি। তারপর সালালায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৭০-৮০ কর্মীকে কাজ শিখিয়ে শুরু করেন টুপি তৈরির ব্যবসা। ১৯৯০ সালে তিনি সালালা ছেড়ে আবার মাস্কাটে গিয়ে নকশি টুপির শোরুম খোলেন। টুপি তৈরি হয় সালালায় বিক্রি হয় মাস্কাটে। তারও তিন বছর পর ওমানে দুটো শোরুম। এভাবে নকশি টুপির বড় রকমের বাণিজ্যের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন বেলায়েত। ১৯৯৩ সালে ফেনীতে গড়ে তোলেন ‘সেভেন স্টার হস্তশিল্প কারখানা’। দেশি কাপড় দিয়েই বিদেশি টুপির নকশা অবলম্বনে বাংলাদেশে তৈরি টুপি বিক্রি করেন ওমানে। এই পথ ধরেই ফেনীতে গ্রামীণ হস্তশিল্প, নিউ সেভেন স্টার, জনতা, জনসেবা, হূদয়, আইমন, সুপারস্টার, নিউ সুপার, ভাই ভাই হস্তশিল্প প্রভৃতি নামে টুপি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দাগনভূঞা ও আশপাশের অঞ্চলে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০টি টুপি তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করছেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক।
আশা জাগাচ্ছেন টুপি কন্যারা
আমাদের দেশে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফেনী, রংপুর, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, তেঁতুলিয়া, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় টুপি তৈরি হচ্ছে। ছোট ছোট কারখানায় হাতে এবং মেশিনে টুপি তৈরি করা হয়। গ্রামে টুপি তৈরির কারখানায় নারী শ্রমিকই বেশি। গৃহবধূ থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীরা অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে টুপিতে বাহারি নকশার কাজ করে বাড়তি উপার্জনের মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতা আনছেন। টুপিতে নকশি বা গুটির কাজের মাধ্যমে কুমিল্লার দাগনভূঞা, সেনবাগ, নাঙ্গলকোট, কোম্পানীগঞ্জ, সোনাগাজী, ফেনী সদর, ছাগলনাইয়াসহ আশপাশের কয়েক উপজেলায় প্রায় অর্ধলাখ মহিলার বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বগুড়ার জালি টুপি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দখল করেছে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার। এখানে প্রতিমাসে ১০ লক্ষাধিক পিস জালি টুপি তৈরি হয়, যা বিক্রি হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। বগুড়ার শিবগঞ্জ, মাঝিড়া, মহাস্থান, সারিয়াকান্দি, ধুনট, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, নামজা, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, রায়গঞ্জ, বেলকুচি এবং কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকার ৩ থেকে ৪ লাখ নারী-পুরুষ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভোলা সদর উপজেলার বাপ্তা, কাচিয়া, ইলিশা, রাজপুর, চরসামাইয়া ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের দরিদ্র নারী কারিগরদের সুনিপুণ শিল্পকর্মে বিলাসী টুপির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আরব দেশগুলোতে। চট্টগ্রামের হালিশহরস্থ ‘দেশ বিদেশ মিডিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওমানে টুপি রফতানি করে। জানা যায়, চট্টগ্রামের দেশ বিদেশ মিডিয়া ছাড়া চাদনী অ্যান্ড ব্রাদার্স, ছাকিনা মঞ্জিল, ফেনীর হস্তশিল্প, জনসেবা হস্তশিল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টুপি রফতানি করছে। মঙ্গাপীড়িত এলাকা কুড়িগ্রামের পাশাপাশি ১০টি গ্রামের গৃহবধূ, তরুণী সবাই বছরে গড়ে ৬০ হাজার টুপি তৈরি করে। মধ্যপ্রাচ্যে এসব টুপির গড় মূল্য এক হাজার টাকা হিসেবে এসব গ্রামে বছরে প্রায় ছয় কোটি টাকার টুপি তৈরি হয়। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায়, রংপুর সদর, লালমনিরহাটের তিস্তাচর, কড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন গ্রামের ১৫ হাজার মহিলা টুপি বানিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। হোমনার ছয়টি গ্রামে রয়েছে তিনশ’র বেশি কারিগর। নওগাঁর নিয়ামতপুর ও মহাদেবপুর উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রামে টুপি তৈরি হচ্ছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিলকাজুলি, অলোয়া, শ্যামগাতী, পিরহাটি, খাদুলী, হিজুলী, সাগাটিয়া, কাশিয়াহাটা, ভুবনগাতী, শাকদহ, পেঁচিবাড়ী, জালশুকা, বিশ্বহরিগাছা, বহালগাছা, বেলকুচি, মথুরাপুর ও মাটিকোড়সহ প্রায় দেড়শ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে টুপি তৈরির কাজ। তেঁতুলিয়ার আজিজনগর, মাথাফাটা, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের দুই শতাধিক নারী ও পুরুষ টুপি তৈরির কাজের সম্পৃক্ত। ফরিদপুর শহরের পদ্মা নদীর ভাঙনে সর্বস্ব হারানো শতাধিক পরিবারের নারী সদস্যরা টুপি তৈরি করে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের হাতের সুনিপুণ দক্ষতায় টুপি তৈরিতে এনেছে আধুনিক মাত্রা এবং অর্জন করেছেন ‘টুপি কন্যা’র খেতাব।
লেখক : এস এম মুকুল
কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
writetomukul36@gmail.com
© দিন পরিবর্তন