logo

বিদ্যুৎবিভ্রাটে সংকটে শিল্প ও কৃষি খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:15 Jul 2022, 05:19 PM

বিদ্যুৎবিভ্রাটে সংকটে শিল্প ও কৃষি খাত


চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদনের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সংকটে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের বিদ্যুৎ খাত। বেশ কিছুদিন ধরে বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছে শিল্প ও কৃষি খাত। বিদ্যুতের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে।  রাজধানীর বাইরে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছে।

বিদ্যুতের অভাবে সেচযন্ত্র বন্ধ থাকায় চলতি আউশ মৌসুমের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  এ অবস্থায় বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় চলছে সারা দেশে লোডশেডিং।  একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় অফিসে কর্মঘণ্টা কমানোসহ হোম অফিস চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় আমদানিনির্ভরতা কমাতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।  দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থাকলেও অনুসন্ধান কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।  আমাদের সাগর এলাকায়ও গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক পরিমাণে বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনাই বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ কমানোর একমাত্র উপায়।

বিদ্যুৎ উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।  তাছাড়া দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম।  এর বাইরে আরো কয়েকটি কারণ আছে।  এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে গত জানুয়ারির পর থেকে ভর্তুকি বন্ধ রেখেছে সরকার।  এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।  ফলে বাধ্য হয়ে তেলচালিত কিছু কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

অন্যদিকে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, সেই কাজ চলছে।  ভারত থেকে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত, ওদের ওই কেন্দ্রটির সমস্যা হয়েছে এ কারণে সেটাও আসছে না।  ফলে বর্তমান এই সংকট তৈরি হয়েছে।  এ মুহূর্তে ভর্তুকি ও জ্বালানি চাহিদা মিটিয়ে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয় উৎপাদনে চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার।  ফলে দ্রুত এই সংকটের সমাধান হচ্ছে না বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের বিদ্যুতের ৫২ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উৎপাদিত হয়, যার ক্রমহ্রাসমান অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির দ্বারা সম্পূরক হয়েছে।  দেশের ২২ হাজার ৬৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় ৮ শতাংশ কয়লা থেকে আসে এবং বাংলাদেশের সেই শতাংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়নি।  গত বছরে বাংলাদেশ ১০টি কয়লা-বার্নিং পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করেছে কিন্তু কিছু বড় প্ল্যান্টের নির্মাণ কাজ চলছে- যা এখনো শেষ হয়নি।  এদিকে বিশ্বব্যাপী এলএনজি বাজারে তীব্র মূল্যবৃদ্ধিতে আপাতত কেনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎসহ দেশের ৫৩টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদুৎ দৈনিক চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে।  শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উৎপাদনকারীদের মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ ও কনফিডেন্স।

অস্থিরতা দেখা দিয়েছে জ্বালানির দামে। সেই অস্থিরতার ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। জ্বালানির দামের অস্থিরতার কারণে বেসরকারি উৎপাদনকারীর বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে অর্থ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। প্রতি মাসে বিপিডিবি ৩,৫০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনে।  গ্যাসের সংকটের কারণে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। ফলে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও।  এতে চার মাসের বিল দিতে পারেনি বিপিডিবি।  ফলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কিছু প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে।

এদিকে গ্যাসের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে রাজধানীসহ সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায়।  সেই সঙ্গে কিছু কিছু এলাকায় শিল্পে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে।  এর মধ্যে কেবল গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকায় গ্যাসের চাপ কিছুটা ভালো।  গ্যাস সংকটের কারণে শিফট কমিয়ে ও ইউনিট বন্ধ করে সমন্বয় করছেন বলে দাবি করছেন তৈরি পোশাক, সিরামিকস, রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা।

গাজীপুরে স্থাপিত দেশের সিরামিক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান গ্রেটওয়াল সিরামিকসের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।  বাংলাদেশ সিরামিকস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং গ্রেট ওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল হুদা বলেন, গ্যাসের চাপ ঠিকমতো না পাওয়ায় জুন মাসে ১৫ দিনের মতো কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে।  চলতি মাসে সংকট আরো বেড়েছে।  তিন শিফটের কারখানা কোনো রকমে এক শিফটে চালু রাখছি।

স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, গত ৫-৬ দিন ধরে গ্যাস সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।  গাজীপুর ও ভালুকায় অবস্থিত দুটি কারখানায় গ্যাসের চাহিদাও দিনে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ২ পিএসআই পাওয়া যায়, যেখানে অনুমোদিত পিএসআই ১৫ দশমিক ৩১ কেভি লাইনের বিদ্যুৎও দিনে পাঁচ ঘণ্টা থাকে না।  এখন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা ও মান ঠিক রাখতে আলাদা করে ডিজেল ক্রয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে, যাতে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা করে বাড়তি খরচ হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের এনজি ফেব্রিকস লিমিটেড, শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডসহ অন্তত পাঁচটি কারখানার তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে গ্যাসের চাপ শূন্য থেকে দুইয়ের মধ্যে থাকে।  স্পিনিং মিল মালিকদের নিজস্ব একটি সামাজিক যোগাযোগের গ্রুপে তারা ইস্যুটি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে চলছেন।

একাধিক শিল্প-মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকায় তাদের উদ্বেগ বাড়ছে এবং তারা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে রয়েছেন।  টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি নিয়ে করণীয় নির্ধারণে গত সপ্তাহে সংগঠনটির নেতারা রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সভা করেছেন।  তারা ইস্যুটির দ্রুত সমাধান চেয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের খোরশেদ আলম।

অন্যদিকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা মনে করেন, বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির দাম কমার পর মানুষের চাহিদা মেটানোই বর্তমানে একমাত্র প্রতিকার।  তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান জ্বালানি সরবরাহের একটি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত লোড ব্যবস্থাপনা জনগণের ভোগান্তি কমাতে পারে।  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর গ্যাস সংকটে ভোগা বিশ্বের দেশগুলোতে বিদ্যুৎ বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়।  বেশিরভাগ দেশই সঠিক উপায়ে লোড ব্যবস্থাপনার দিকে ঝুঁকছে বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক সাবেক বিশেষ সহকারী, অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ তামিম বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি বিবেচনায় খরচ সাশ্রয়ের জন্য লোডশেডিংই সেরা বিকল্প।  জাপানের সরকার যদি নাগরিকদেরকে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করতে নিষেধ করে তাহলে অন্তত ৮৫ শতাংশ মানুষ তা মানবে, কিন্তু বাংলাদেশে এটি অসম্ভব।  একারণেই সরকার লোডশেডিং চালু করেছে।  এতে অন্তত জনগণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে ভুগবেন না।  তবে, ঠিক কোন কোন দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে তা যেন কর্তৃপক্ষ আগেই ঘোষণা করে সেই পরামর্শ দেন তিনি।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এবং সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শামসুল আলম বলেন, সঠিকভাবে লোড ম্যানেজমেন্ট গ্যাস ও বিদ্যুতের বর্তমান উৎপাদন হারের মধ্যেও জনগণের দুর্ভোগ কমাতে পারে।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, এ ধরনের পরিকল্পিত লোড ম্যানেজমেন্ট মেকানিজম আমাদের এখানে দেখা যায় না।  এর ফলে দেশের কিছু অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  অন্যদিকে অন্যান্য এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।  এ অবস্থায় গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবহার বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ ডলার ছাড়িয়েছে।  সর্বশেষ তা কেনা হয়েছে ২৫ ডলারে।  দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় আপাতত স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) এলএনজি থেকে কেনা হচ্ছে না। এ অবস্থায় জ্বালানি ঘাটতি মোকাবিলায় সারা দেশে চলছে লোডশেডিং।  তবে গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে এ পরিস্থিতি আপাতত উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই।

তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ খাতে গত জানুয়ারির পর থেকে ভর্তুকি বন্ধ রাখা হয়েছে।  এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।  আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তেলচালিত কিছু কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে।  চলমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে শিগগিরই এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সময়সূচি ঘোষণা করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মনে করেন, সাশ্রয়ী পদক্ষেপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার মেগাওয়াট কমানোর যাবে।
বিশ্ব পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল নাহলে-আমরা চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারতাম।

তিনি বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামের অস্থিরতা আমাদের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। সরকারকে এখন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিপুল ভর্তুকির ভার বহন করতে হচ্ছে। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি এখানেই শেষ হবে।  পরিস্থিতি কোন দিকে যায় আমাদের সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।  আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
তিনি জানান, বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, তবে এর পরে কিছু কয়লা-বার্নিং পাওয়ার প্ল্যান্ট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে, যা স্বস্তি আনতে পারে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এই পরিস্থিতি সাময়িক। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর কথা ভাবছেন।  আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।  গ্যাসের সংকটের কারণে আমরা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি।  আমরা সার কারখানা এবং অন্যান্য শিল্পে গ্যাস সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি।  যদি আমরা সবাই গ্যাস ব্যবহারে মিতব্যয়ী হয়ে উঠি, তাহলে আমি আত্মবিশ্বাসী-যে আমরা এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারব।



© দিন পরিবর্তন