নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:28 Jul 2022, 05:56 PM
বিপাকে ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
২৭ জুলাই। সকাল সাড়ে ৯টায় বিদ্যুৎ চলে যায়। ৪ ঘণ্টা পর ফের বিদ্যুৎ আসে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, বায়তুল মোকাররমসহ আশপাশের এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে ব্যাংকপাড়ায় সৃষ্টি হয় ভূতুরে পরিবেশ। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে জেনারেটর চালালেও বিদ্যুতের চেয়ে বেশি খরচ হয় জ্বালানি তেলে। তাই অনেকে অনেকে জেনেরেটর চালান না। এসময় বেশিরভাগ মানুষ অফিসের বাইরে সময় কাটান। বিদ্যুৎ বিভাগ বলতে পারছে না কখন লোডশেডিং হবে।
জানা গেছে, গতকাল রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকায় বিদ্যুতের একটি ট্রান্সমিটার বিকল হওয়া এমন ঘটনা ঘটে। সবমিলিয়ে ৪ ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ আসে। প্রতিদিন অফিসে কাজ শুরুর পরেই লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, দৈনিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে উল্টো চিত্র। প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ বারের লোডশেডিং হচ্ছে। আর এ কারণে বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, যখন তখন ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় হোটেলের খাবার নষ্টের পাশাপাশাশি কমে গেছে বেচা-কেনা। আর সন্ধ্যায় লোডশেডিংয়ে নাস্তাও বন্ধ হয়ে যায়। সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার খেতে কাস্টমার আসতে চায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুপুর ১২ টায় বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আসে টানা এক ঘণ্টা পর। এভাবেই দুপুর, দুপুরের পর, বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে ও ভোরে একাধারে চলছে লোডশেডিং। এক ঘণ্টা, পৌনে এক ঘণ্টা, আধা ঘণ্টা করে ৩/৪ বার হচ্ছে লোডশেডিং। তাই বেশি বিপাকে পড়েছেন হোটেল ব্যবসায়ী এবং মুদি দোকানিরা। মালামাল নষ্টসহ বেচা-কেনা কমে গেছে তাদের।
লোডশেডিংয়ের সময় কেউ কেউ বিকল্প ব্যবস্থায় লাইটের ব্যবস্থা করলেও তাতে ব্যয়ও বাড়ছে বলে জানান মনখুশি হোটেল ব্যবসায়ী সুদাংশু দাস। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক এলাকায় পিক আওয়ারে বিশেষ করে দুপুর ১২ টা থেকে ৪ টা এই সময়ে লোডশেডিং হলে হোটেলের খাবার সংগ্রহ বা বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। অফিসপাড়ার চাকরিজীবীরাও খাবার খেতে পারছেন না সময় মতো।
তিনি বলেন, বাণিজ্যিক এলাকায় লোডশেডিংয়ের সময় সকাল ১০ টার আগে এবং বিকেল ৫ টার পর নির্ধারণ করলে নিম্নবিত্ত হোটেল ব্যবসায়ীদের ভালো হয়। সুদাংশু দাসের মতো ৩৭/২ পুরানা পল্টন এলাকায় প্রিয়তম জামান টাওয়ারের ক্ষুদ্র ফাস্ট ফুডের ব্যবসায়ী শংকর চন্দ্র দাস ও ইকবাল হোসেনও একই কথা বলেন। তারা বলেন, লোডশেডিংয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমাদের রান্না করার প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্য বিক্রি করতে পারছি না, অনেকে না খেয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে নতুন করে আমরা অভাবের সম্মুখীন হচ্ছি। কারোনাকালীন ২ বছরে লাখ লাখ টাকা লোকাসান হয়েছে। আমরা এখনো সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। হোটেলের কর্মচারীদের বেতন, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিলেও কোনো ছাড় পাচ্ছি না। কোনো সরকারি সহায়তাও পাইনি। তারা জোর দিয়ে সরকারের কাছে আহ্বান জানান অফিস আওয়ারে লোডশেডিং না দেওয়ার জন্য।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁয় লোডশেডিংয়ের কারণে ভোগান্তির মধ্যে আছে মানুষ। কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আউশ ও রোপা আমনের খেতে সেচ দিতে সংকটে পড়েছেন কৃষক। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের লিচুবাগান এলাকার গৃহিণী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সারা দিনে কতবার বিদ্যুৎ যায়, তার হিসাব নেই। এক সপ্তাহ ধরে শুধু রাতেই পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ধরে লোডশেডিং হচ্ছে। গরমের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। বাচ্চাটার ঠিকমতো পড়াশোনাও হচ্ছে না।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নওগাঁর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছেন। এ কারণে ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
নওগাঁ পল্লী সমিতি-১ এর উপমহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) প্রকৌশলী লুৎফুল হাসান সরকার বলেন, নওগাঁ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর গ্রাহকসংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার। এই পরিমাণ গ্রাহকের প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৯০ মেগাওয়াট। তবে বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট করে।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবিএল) রাজশাহী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন।
রংপুর জেলায় প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ১৫০-১৫৫ মেগাওয়াট। সেখানে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৮০-৮৫ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি থাকায় জেলায় দিনে ও রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়ির লোকজন চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
নেসকো রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন জানান, রংপুর বিভাগের আট জেলায় রাতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। মঙ্গলবার দিনের বেলা এই বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৬৫০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৪০০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ ২৫০ মেগাওয়াট ঘাটতি।
এদিকে সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ছয়দিন ধরে লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ শহরের কাপড় ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তাফা বলেন, লোডশেডিং বেড়ে যায়, তাহলে তো আমরা ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাব। এমনিতেই করোনার কারণে গত কয়েকটি ঈদে ব্যবসা হয়নি।
নেসকো সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রউফ বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরের জন্য কমপক্ষে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন থাকলেও, পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৪-১৫ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সরবরাহ না দিলে কিছুই করার নেই।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২৪ ঘণ্টায় ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। দেশের উষ্ণতম স্থান হিসেবে পরিচিত এই উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ। সাংসারিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প কলকারখানা ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কবে নাগাদ এই বিপর্যয় কাটবে, তা বিদ্যুৎ বিভাগ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না।
নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর লালপুর জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) রেজাউল করিম খান বলেন, উপজেলায় আটটি ফিডারে পর্যায়ক্রমে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ডিজেলের ব্যবহার কমাতে এক-দুই ঘণ্টার লোডশেডিং দিয়ে কোনো সুফল মিলবে না বলে মত নগর পরিকল্পনাবিদদের। তাদের মতে, জেনারেটরের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ডিজেলের ব্যবহার উল্টো বাড়বে। তাই সাপ্তাহিক ছুটি একদিন বাড়ানো, ব্যক্তিগত যানের ব্যবহার কমানোসহ অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য সুনির্ধারিত পরিকল্পিত সময়সীমা নির্ধারণের পরামর্শ তাদের। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের কবলে পুরো দেশ। ফলে বাধ্য হয়েই বাসাবাড়িসহ রাজধানীর সব জায়গায় বেড়েছে জেনারেটরের ব্যবহার। এমন বাস্তবতায় নগর পরিকল্পনাবিদদের শঙ্কা, জেনারেটরের তেলের বাড়তি চাহিদা মেটাতে গিয়ে জ্বালানি সাশ্রয় তো হবেই না। উল্টো বিরূপ প্রভাব পড়বে।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, করোনার কারণে আমাদের যে লোকসান হয়েছে, সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি আমাদের থমকে দিয়েছে বরং এখন পণ্যের দামের কারণে খাবার বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমরা আর টিকতে পারছি না। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতির পরও কোনো হোটেল- রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ানো হয়নি। যদিও মজুরি ও খরচ অনেকগুণ বেড়েছে। কম টাকায় মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাস-পানির দামও বাড়ানো হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি। এ পরিস্থিতিতে সর্বস্বান্ত হওয়া ছাড়া গতি নেই। লোকসানে অনেকেই রেস্তেরাঁ বন্ধ করে দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় চলমান লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ বেশিদিন থাকবে না বলে আশা প্রকাশ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব সব জায়গাতে পড়েছে। করোনার ধাক্কা যখন সবাই কাটিয়ে উঠছিল তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বকে গভীর এক সংকটে ফেলেছে। এ সংকটে শুধু উন্নয়নশীল নয়, অনেক উন্নত দেশেও এর আঁচ লেগেছে। যুদ্ধের প্রভাব জ্বালানি মার্কেটকে চরম অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এতে আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারও বেসামাল। বৈশ্বিক এ সংকট আমাদেরও বিপদে ফেলেছে।
© দিন পরিবর্তন