দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:22 Feb 2024, 09:11 PM
মনের ভাব প্রকাশে মাতৃভাষাই সেরা
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির:
মনের ভাব প্রকাশ করার অন্যতম মাধ্যম মাতৃভাষা। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে তার খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষ মহান আল্লাহ তায়ালার সেরা সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা গভীর মনোনিবেশ, চিন্তা-ভাবনা, উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করার ক্ষমতা দিয়েছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন, স্মরণ শক্তি দিয়েছেন। মানুষকে তিনি দান করেছেন সুন্দর অবয়ব। ইরশাদ হয়েছে : আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে (সূরা তীন : আয়াত ৪)।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা শুধু সুন্দরতম আকৃতিতেই সৃষ্টি করেননি, তিনি তাকে মনের ভাব প্রকাশের জন্য কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে (সুরা আর রহমান : আয়াত ৩-৪)। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য তার মাতৃভাষাই হচ্ছে সর্বোত্তম মাধ্যম। যত সহজে মনের ভাব মাতৃভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব হয় অন্য কোনো ভাষায় তা তত সহজে ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না। অন্য ভাষা অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব হলেও তা উচ্চারণের সঙ্গে বা মায়ের ভাষা অর্থাৎ নিজের ভাষার সঙ্গে মস্তিষ্কে তার বোধগম্যতা প্রতিধ্বনিত হয়। আমরা অন্য ভাষাকে অনুধাবন করি নিজের ভাষাতেই তথা মাতৃভাষার মাধ্যমেই। মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদত বরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথে উৎসর্গকৃত তাজা রক্তের বদৌলতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে এবং রক্তে রঞ্জিত ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হয়। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা সৃষ্টিতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনই প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে।// ভাষা আন্দোলনের এই গৌরবোজ্জ্বল রক্তিম ইতিহাস জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে যুগ থেকে যুগান্তরে। যা আমাদের প্রেরণা যোগায়, গর্বের সাথে পথ চলার সাহস যোগায়।
পৃথিবীতে বর্তমানে অসংখ্য ভাষা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু অপ্রচলিত ভাষার অস্তিত্বও কোনোভাবে টিকে আছে। কালক্রমে কিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে মানব সভ্যতার উত্থান-পতনে। আবার কিছু ভাষা বিলুপ্তির পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে হিদায়াত দান করার জন্য, সত্য-সুন্দর পথে চলার পথ নির্দেশনার জন্য, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার জন্য, এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই- এই সত্য কায়েম করার জন্য যুগে যুগে বহু নবী-রাসলকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তারা যে দেশে বা যে জনপদে প্রেরিত হয়ে এসেছেন সেই দেশের বা জনপদের মানুষের মাতৃভাষাতেই তারা হিদায়াতের বাণী প্রচার করছেন। এরশাদ হচ্ছে: আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষি করে প্রেরণ করেছি, তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪)। এই আয়াতে কারিমায় মাতৃভাষার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা লক্ষ্য করি যে, পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষার এই বিচিত্র সম্ভার মানব সভ্যতাকে জ্ঞানরাজ্যের ধারাবাহিক স্রোতে যেন অবগাহন করাচ্ছে। ভাষার বিচিত্রতা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর কুদরত ও নিয়ামতেরই অপূর্ব নিদর্শন। আল্লাহ্ এই অপূর্ব নিদর্শন সম্পর্কে কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : এবং তার (আল্লাহ) নির্দেশনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য (সুরা রুম : আয়াত ২২)।
পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুল এসেছেন। তারা সকলেই তওহিদ প্রচার করেছেন, ইসলামের পথে মানুষকে আহ্বান করেছেন। তাদের মধ্যে সহিফা পেয়েছেন অনেকেই, কিতাব পেয়েছেন কয়েকজন। সেই সমস্ত পুস্তিকা বা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের ভাষা সংশ্লিষ্ট নবী বা রাসুলের নিজস্ব ভাষা। সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা আরবিতে নাজিল হয়েছে পবিত্র আল কোরআন। কেন কোরআন মজিদকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু আরবি ভাষায় নাজিল করলেন সে সম্পর্কে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)কে সম্বোধন করে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তো আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পারেন এবং এর দ্বারা বিতন্ডাপ্রবণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিতে পারেন (সূরা মরিয়াম : আয়াত ৯৭)। এই আয়াতে কারিমায় উল্লিখিত : ‘আমি তো আপনার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি’- এই কালাম মজিদ মাতৃভাষার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা সুস্পষ্টভাবে নিরূপণ করে দেয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচারক দল গিয়েছেন। তারা যে অঞ্চলে বা যে দেশে গিয়েছেন প্রথমে সেখানকার মানুষের ভাষা তাঁরা আত্মস্থ করেছেন এবং সেখানকার ভাষাতেই ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। প্রিয় নবী (সা.) লোহিত সাগরের ওপারে অবস্থিত আবিসিনিয়ায় একদল সাহাবি প্রেরণ করেন। এই দল প্রেরণের পূর্বে হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুকে আবিসিনিয়ার ভাষা আয়ত্ত করতে নির্দেশ দেন। অত্যন্ত মেধার অধিকারী হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব (রা) কয়েকদিনের মধ্যে আবিসিনীয় ভাষা শিখে ফেলেন এবং আবিসিনিয়ার হিজরতকারী দলের সঙ্গে গমন করেন। আবিসিনিয়ায় পৌঁছে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজমীর দরবারে তিনি যে বক্তব্য তুলে ধরেন তা আবিসিনীয় ভাষায়। পারস্য দেশের একটি প্রতিনিধিদল প্রিয়নবী (সা.)-এর দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা দেশে ফিরে যাবার প্রস্তুতিকালে কোরআন মজিদের কিছু অংশ তাদের মাতৃভাষা ফারসিতে অনুবাদ করে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে প্রিয় নবী (সা.)-এর নির্দেশক্রমে হযরত সালমান ফারসি রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু সূরা ফাতিহাকে ফারসি ভাষায় তরজমা করে দেন। ফারসি ভাষাভাষি অঞ্চলে ইসলামের দ্রুত প্রসারের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, ইসলামের কিতাবাদি ফারসি ভাষায় অনুবাদের ফলেই ত্বরিত ইসলাম সেখানে বিস্তৃত হয়। বড় বড় কবি-সাহিত্যিক ফারসি ভাষায় ইসলামের নানা বিষয়ে বড় বড় গ্রন্থ রচনা করেন। জালালুদ্দীন রুমি, হাফিজ, জামী, আনওয়ারী, ফেরদৌসীসহ অনেকেই ইসলাম বিষয়ক লেখালেখি করে অমর হয়ে আছেন।
পৃথিবীর সব জনপদে নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত কথা প্রকাশের প্রিয় ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শিখে বিধায় তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা হিসাবে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকেন।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণী-‘আমার নিদর্শনগুলোর মাঝে রয়েছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য; জ্ঞানীদের জন্য এতে সুনিশ্চিত অনেক নিদর্শন রয়েছে (৩০:২২)।’ পৃথিবীর অপরাপর সব জিনিসের মতো মাতৃভাষার স্রষ্টাও স্বয়ং মহামহিম আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের মনের ভাব-বর্ণনা (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন (৫৫:৩-৪)।
পৃথিবীর নানা জাতির বসবাস এবং তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষাও রয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো সহ ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিশ্বের কিছু জাতিগোষ্ঠীর। কিন্তু বাঙালি জাতি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছে; যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত, বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা। বাংলাকে সব বিকৃতি থেকে রক্ষা করা।
/মামুন
© দিন পরিবর্তন