logo

মুরাদনগরে ভেকু মেশিন দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ

প্রতিনিধি

Published:04 Feb 2024, 03:42 PM

মুরাদনগরে ভেকু মেশিন দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ


কুমিল্লা :
কুমিল্লার মুরাদনগরে তিন ফসলি কৃষি জমির বুক চিরে ছুটছে ট্রাক্টরের পর ট্রাক্টর। লক্ষ্য ফসলি জমি থেকে কাটা মাটি ইটভাটায় নিয়ে আসা। সামান্য অদূরেই চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝ খান থেকে অত্যাধুনিক ভেকু মেশিন দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। সে মাটি সংগ্রহে ব্যস্ত অসংখ্য ট্রাক্টরের শ্রমিক। যে জমির উপরিভাগে ধান বোনা হতো, সে জমিতে এখন বিশাল আকারের র্গত। এভাবেই মুরাদনগর উপজেলার বিপুল পরিমান তিন ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। এতে করে ওই জমিগুলো যেমন উর্বরতা হারাচ্ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে এসব ফসলি জমি।

এদিকে উপজেলার ৫৪টি ইটভাটা জমির টপ সয়েল কেটে নিলেও রহস্যজনক কারণে এসব দেখেও না দেখার ভান করছে উপজেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সকল সেক্টরকে ম্যানেজ করেই ইটভাটা মালিক সিন্ডিকেট মিলে উর্বর তিন ফসলি জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে সচেতন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অপর দিকে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এভাবে মাটি কেটে নিলে ফসলি জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিবে।

পতিত জমি, খাল, বিল, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল থেকে মাটি কেটে নেওয়া যাবে না ইট তৈরীর জন্য। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর ৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না মুরাদনগর উপজেলায়। দিনের পর দিন প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপজেলায় গড়ে ওঠা ৫৪টি ইটভাটায় মুরাদনগর সদর, যাত্রাপুর, মোচাগড়া, বাখরনগর, বাখরাবাদ, পায়র, সুবিলারচর, রানীমুহূরী, শুশুন্ডা, দারোরা, বড় আলীরচর, সোনাপুর, চাপিতলা, কুড়াখাল, বাবুটিপাড়া, ছালিয়াকান্দি, বোরারচর, চন্দনাইল, রোয়াচালা, শ্রীকাইল বিলের কৃষিজমি, গোচারণ ভূমি, জলাশয় ও গোমতী নদীর পাড়ের গুঞ্জুর,উত্তর ত্রিশ, দক্ষিণ ত্রিশ ও ধামঘর এলাকার মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। আইন লঙ্ঘনকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাস্তবে ফসলি জমি ধ্বংসের মহোৎসব চলছে এই উপজেলায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার প্রায় ৫৪টি ইট ভাটার মালিক ফসলি জমি থেকে অবাদে মাটি কেটে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে নবীপুর পূর্ব ইউনিয়নের বখরনগর মৌজায় ১৭টি ইটভাটা থাকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে সেই ইউনিয়নে। অব্যাহত ভাবে লাগামহীন মাটি খননের কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে তিন ফসলি কৃষি জমি। ঠিক তেমনি নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বর শক্তি আর জীববৈচিত্র।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর প্রতিটি ভাটায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ ইট উৎপাদন (পোড়ানো) হয়। উপজেলায় থাকা ৪৬টি ইটভাটার মাটি কাটার জন্য ফসলি জমির মাঠে কাজ করছে ২৭টি খননযন্ত্র ও প্রায় ৩২২টি ট্রাক্টর।প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটি ভর্তি ট্রাক্টরগুলো ফসলি জমির উপর দিয়ে জোরপূর্বক রাস্তা তৈরি করে চলাচল করছে। এতে ধুলাবালুতে দুই পাশের জমির ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারছে না নিরীহ কৃষকেরা। আবার কেউ কেউ লিখিত অভিযোগ দিয়েও পাচ্ছে না প্রতিকার।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে নদী-নালা খাল-বিল বাদে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার ২৮ হেক্টর ফসলী জমি রয়েছে। শ্রেণী ভেদে প্রায় সকল জমিতেই সারা বছর কোনো না কোনো ধরণের ফসল চাষ করে কৃষকরা। এক শ্রেণীর কৃষকরা ভাটা মালিকদের লোভে পড়ে প্রতি গাড়ি (ট্রাক্টর) মাটি পাঁচ’শ থেকে ছয়’শ টাকায় বিক্রয় করছেন। যে কারণে ওইসব জমিতে না হচ্ছে ধান ও না হচ্ছে মাছের চাষ। জমি গুলো দেখে মনে হচ্ছে এ যেন উম্মুক্ত জলাশয়। নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে নির্বিচারে আবাদি কৃষি জমি থেকে মাটি খনন করায় দিন দিন কমে যাচ্ছে তিন ফসলী জমি। অন্য দিকে উর্বর শক্তি কমে গিয়ে ফসল উৎপাদনে হ্রাস পাচ্ছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খাঁন পাপ্পু জানান, কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে গর্ত করার কারণে ফসলী জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মাটির উর্বর শক্তি কমে যাওয়ায় ওই জমিতে তেমন আর ফলন হয় না। ফলে ফসল চাষে চাষিদেরও আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এই ধরনের কর্মকান্ডে বন্ধ করতে না পারলে আগামীতে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।

মাটি কাটা সিন্ডিকেটের সদস্য সালাউদ্দিন, শাকিল, আলা, আমির হোসেন বলেন, আমরা কৃষকদেরকে ন্যায্য মূল্য দিয়েই তাদের জমির মাটি ক্রয় করে থাকি। কাউকে জোর জবরদস্তি ছাড়াই সব সেক্টর ম্যানেজ করে আমরা মাটি ক্রয় বিক্রয়ের কাজ করে থাকি।

মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ সিকদার বলেন, ইতিমধ্যে ৪টি ইটভাটাকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কোন ইটভাটা মালিক ও মাটি কাটার সিন্ডিকেটের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। মাটি কাটার বিষয়ে আমরা কাউকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেই না। এসব মাটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।



© দিন পরিবর্তন