দিন পরিবর্তন ডেস্ক
Published:21 Nov 2023, 04:46 PM
মোটরসাইকেল শিল্পের সম্প্রসারিত বাজার
দেশে মোটরসাইকেল শিল্পের রয়েছে বিশাল বাজার। দেশি-বিদেশি কোম্পানির তৈরি মোটরসাইকেল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এ বাজার। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয়, এই বিশাল বাজারে দেশি কোম্পানিগুলোর অংশীদারি একেবারেই সামান্য। বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত অধিক সক্ষমতার কারণে প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে দেশি কোম্পানিগুলো কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০২১ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, দেশে ক্রমেই প্রসারিত হওয়া মোটরসাইকেল পণ্যের বাজার প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার। এর প্রায় পুরোটাই বিদেশি পণ্যের দখলে। স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্পের অংশ মাত্র ২০ কোটি টাকা। প্রশ্ন জাগে, ২ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজারে আমাদের অংশীদারিত্ব মাত্র ২০ কোটি টাকা কেন? যারা নিজেদের দেশের গ্রাহকের সন্তুষ্টি অর্জন করে বিদেশে পণ্য রফতানি করতে পারে, তাদের দেশ কেন মোটরসাইকেল শিল্পে পিছিয়ে থাকবে, আর কেনই বা থাকবে অবাধে বিদেশি পণ্যের সুযোগ ?
এ দেশে মোটরসাইকেলের প্রচলন নিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে তখন এত পাকা রাস্তা ছিল না। সেই সময় মহকুমা বা থানা পর্যায়ে কাঁচা সড়কের আধিক্য থাকলেও এসব রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে চলতে দেখা গেছে জাপানি মোটরসাইকেল। অনেক পথচারীকে উৎসুক নয়নে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে ছুটে চলা মোটরসাইকেলগুলোর দিকে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা দূর থেকে মোটরসাইকেল আসার শব্দ শুনতে পেলেই ছুটে যেত রাস্তার ধারে মোটরসাইকেল দেখতে। সেই সময়ে উচ্চমূল্যের কারণে মোটরসাইকেলগুলো কেবলই দেখা যেত বিত্তশালীদের ঘরে। তখন মোটরসাইকেল মানেই খানদানি পরিবারের প্রতীক।
আজকাল শুধু বিত্তশালী নয়, মোটরসাইকেল এখন মধ্যবিত্তসহ সমাজের সিংহভাগ মানুষের হাতের নাগালে। দিনে দিনে মোটরসাইকেল নিত্যব্যবহার্য গৃহস্থালী সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। কী গ্রাম কী শহরÑ পাড়া-মহল্লার প্রতিটি ঘরে একাধিক মোটরসাইকেল এখন দেখতে পাওয়া যায়। রাত-বিরাতে, আপদে-বিপদে যানবাহনের সন্ধান না করে হালকা বাহন মোটরসাইকেলে চেপেই এখন মানুষ বেরিয়ে পড়ে। তাই চাকরি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ জীবনযাত্রার সার্বিক প্রয়োজনে মোটরসাইকেল বড় ধরনের ভ‚মিকা রাখছে। এমনই একটি পণ্যের বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া যদি এখনও বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রভাব বলয়ে থাকে এবং দেশের টাকা বিদেশে চলে যাওয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে জাতীয় অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকেই যায়।
সময়ের গতিধারায় পাল্টে গেছে যুগ। পাল্টে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের জীবনে লেগেছে যান্ত্রিকতার ছোঁয়া। জাপান থেকে মোটরসাইকেল নির্মাণের প্রযুক্তি এসে যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। হোন্ডা কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি হয় হিরো-হোন্ডা। দামও চলে আসে মধ্যবিত্তদের হাতের নাগালে। সময়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওপারের প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি হতে থাকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের মোটরসাইকেল। মূলত এভাবেই এদেশের বাজারে বৃদ্ধি পায় মোটরসাইকেলের আধিক্য ।
আরো পরে মূল্য কম হওয়ার সুবাদে চায়না মোটরসাইকেল চলে আসে একবারে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে। এরই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে জাপান, ভারত, চীনের পর আমাদের দেশে তৈরি হতে শুরু করে মোটরসাইকেল। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের কয়েকটা কোম্পানি কোনো কোনো দেশে মোটরসাইকেল রফতানি শুরু করেছে আরো কয়েক বছর আগে। যার ফলে এক সময়ের আমদানিনির্ভর এ শিল্প এ দেশেই এখন রফতানিমুখী হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঠিক সেই সময় মোটরসাইকেল শিল্পের ওপর প্রকাশিত একটি সংবাদে নানা রকম বিরূপ চিত্র উঠে এসেছে। এ শিল্পবিরোধী দেশীয় কিছু নিয়মনীতির কারণে এখনো আমদানিপ্রবণতা রয়েই গেছে।
এমনও শোনা গেছে, বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী একটি দেশে মোটরসাইকেল রফতানির উদ্যোগ নেওয়া হলে ওই দেশের অস্বাভাবিক মাত্রার করারোপের কারণে রফতানির ইচ্ছা ভেস্তে যায়। আসলে নিজেদের শিল্পের অনুকূলে বাজার ব্যবস্থপনার জন্য তাদের ওই করারোপ। কিন্তু আমরা দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় আজ পর্যন্ত কোনো নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার আজ বিদেশি কোম্পানিগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমাদের ভাবতে হবে, এ থেকে বেরিয়ে এসে কীভাবে দেশি মোটরসাইকেলের মান আরো উন্নত করে বাজার দখলে নিয়ে নিজেদের অর্থের সাশ্রয় করা যায়।
আমরা যদি যথাযথভাবে এ শিল্পের মান উন্নয়ন করতে পারি এবং বিদেশি পণ্যের আধিপত্য সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে নিজেদের পণ্য দিয়েই ক্রেতা-চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। সংবাদের আরেকটি অংশে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে সাতটি স্থানীয় ও আটটি আন্তর্জাতিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৩৮টি মোটরসাইকেল উৎপাদন ও সংযোজনকারী শিল্প রয়েছে। এ শিল্পের বার্ষিক উৎপাদন আনুমানিক ৪ লাখ ৪০ হাজার ইউনিট। এটি মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ। তার অর্থ এই দাঁড়ায়, বাকি ২০ শতাংশ চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে দেশি কারখানাগুলো নিজেদের বাজারে পণ্যের যোগান দিয়ে বিদেশেও রফতানির সক্ষমতা অর্জন করেছে, সেখানে বৈদেশিক পণ্যের ওপর আমাদের এত নির্ভরতা কেন? যদি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা আরো প্রসারিত করা যায়, তাহলে অল্প দিনেই আমাদের বাজার থেকে যে অর্থ বিদেশি কোম্পানিগুলো নিয়ে যাচ্ছে, তার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো এখনো মোটরসাইকেলের অনেক সহায়ক যন্ত্রাংশ উৎপাদন করতে সমর্থ হয়নি। এ শিল্পের অনেক উপকরণ বিশেষ করে মোটরসাইকেল চেসিস, চাকা, হ্যান্ডেল বার, ব্রেক সিস্টেম, ফুয়েল ট্যাংক, প্লাস্টিকের পণ্য (মাডগার্ড, ফেন্ডার, সাইড কভার) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলো উৎপাদনে অবশ্যই দেশি কোম্পানিগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে। তা না হলে এ শিল্পে স্বয়ংসম্পন্নতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এ জন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা আগে নিরসন করতে হবে।
আশার কথা যে, বিলম্বের হলেও এ শিল্পের উন্নয়নে ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় ‘মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে। তাও ২০২১ সালের কথা। দুই বছরের ব্যবধানে এই নীতিমালা কতটা দেশি মোটরসাইকেল শিল্পের সহায়ক হয়েছেÑ সেটাও ভাববার বিষয়। প্রয়োজনে সরকারকে বাণিজ্যিক স্বার্থের চেয়ে শিল্প-স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। মোটরসাইকেল শিল্পের এই দেশীয় বিশাল বাজারকে সুরক্ষা দিতে হলে এবং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হলে সুচিন্তিত পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।
একবার এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘হালকা প্রকৌশল শিল্প : মোটরসাইকেল শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ উন্নয়ন প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক অনলাইন সেমিনার করে। ওই সেমিনারে স্থানীয় মোটরসাইকেল শিল্পের প্রসারে সরকারি নীতিমালার ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, তখন মন্তব্য করা হয়েছিল পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। শুধু তাই নয়, দেশীয়ভাবে এসব উপকরণ উৎপাদন সম্ভব হলে একদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে তেমন উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং বিপণন বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। ওই সেমিনারকে আরো গুরুত্ববহ করেছিল খাত-সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতি। সব মিলিয়ে সেমিনারটি ছিল মোটারসাইকেল শিল্পের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে দুই বছর পেরিয়ে গেছে। মোটরসাইকেল শিল্প যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন খাতে শিল্প-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরত ব্যক্তিরা যদি যে যার অবস্থান থেকে আন্তরিক হয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে আগামী দিনে এই শিল্পকে স্বয়ংসম্পন্নভাবে রূপ দেওয়া খ্বু বেশি কষ্টকর হবে না। এজন্য দেশের নীতিনির্ধারণী মহলকে আগে সচেতন হতে হবে। দেশের অর্থনীতির জন্য সেটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। আমরা রফতানিকারক জাতি হিসেবে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়জাত পণ্য এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধশিল্পে যেভাবে সারা বিশে^ আধিপত্য বিস্তার করেছি, ঠিক সেভাবে আরেকটু আন্তরিক হলে মোটরসাইকেল শিল্পেও সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
© দিন পরিবর্তন