logo

রাজধানীতে তীব্র হচ্ছে পানি সংকট

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:10 Aug 2022, 05:11 PM

রাজধানীতে তীব্র হচ্ছে পানি সংকট


জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে নাকাল রাজধানীবাসী।  সেইসাথে দিন দিন তীব্র হচ্ছে পানি সংকট। গ্রাহকদের অভিযোগ, ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ে হটলাইনে কিংবা স্বশরীরে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।  আর ওয়াসা কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশোডিংয়ের কারণেও কমেছে পানির উৎপাদন ও সরবরাহ।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কুড়িল, বিশ্বরোড, ভাটারা নূরের চালা, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, মেরুল ডিআইটি, কালাচাঁদপুর, মিরপুর, আগারগাঁও, রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পানি সংকট বেশি। এসব এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে তারা পানির সংকটে ভুগছেন। কোরবানির ঈদের পর এ সমস্যা শুরু হলেও সম্প্রতি দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের ঘোষণার পর পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

এ বিষয়ে ওয়াসা কর্মকর্তারা জানান, একদিকে কম বৃষ্টিপাত, সেইসাথে জনসংখ্যা ও চাহিদা বাড়ার কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামছে। এজন্য শতাধিক পাম্প বিকল হয়ে পড়েছে। লোডশোডিংয়ের কারণেও পানির উৎপাদন ও সরবরাহ কমছে। পাশাপাশি নতুন পাম্প বসানোরও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রেশনিং করে পাম্প চালাতে হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার ৪ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম বলেন, এ বছর বৃষ্টিপাত ৬০ ভাগ কম, পানির উৎপাদনও কম। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। আমাদের এ এলাকায় ১৩২টি পানি উত্তোলনের পাম্প আছে। এর মধ্যে ৩০টির মতো বোরিং করতে হবে।

বাড্ডার কুমিল্লা পাড়া এলাকায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পানি নেই। এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সিরাজ হোসেন বলেন, বেশ কদিন হয়ে গেল এ এলাকায় পানি নেই। প্রতিদিন দু-এক বার করে পানি আসে। তা দিয়েই সব কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, পানির অভাবে গত দুই দিন ধরে গোসল করতে পারিনি। বালতি নিয়ে এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরেও লোকজন কোথাও পানি পাচ্ছে না। রান্না, খাওয়া, গোসল-সবকিছুই ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে এলাকার লোকজন খুব সমস্যায় আছে।

ভাটারা এলাকার বাসিন্দা হানিফ মৃধা বলেন, সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আমরা ঠিকমতো পানি পাচ্ছি না। বারবার ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ে অভিযোগ জানিয়েও এর প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। পানির সংকটের কারণে এ এলাকার প্রতিটি বাড়িতে মানুষ খুব কষ্টে আছে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকরা ওয়াসার গাড়ি থেকে অতিরিক্ত দামে পানি কিনে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এ পানিও একবার আসে, তখন ভাড়াটিয়াদের জন্য একবার ছাড়া হয় পানি। ওই সময়ের মধ্যে আমাদের গোসল, বাথরুমসহ পানির সব কাজ করতে হয়।

ভাটারার খন্দকার বাড়ির মোড় এলাকার বাসিন্দা মো. আলী বলেন, খন্দকার বাড়ি মোড়ে রাতে আধা ঘণ্টার মতো পানি পাই। এর পর আর সারা দিন খবর থাকে না। মাঝে তিন দিন এক নাগাড়ে পানি আসেনি। কোরবানির পর খেকে এ সমস্যা শুরু, এখনো সমাধান পাইনি।

এ বিষয়ে এ কার্যালয়ের কর্মকতারা বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় খিলবাড়ির টেক পানির পাম্পটি সম্পূর্ণ বন্ধ। এছাড়া, নয়ানগর এলাকার ফাসেরটেকসহ বেশ কয়েকটি পাম্পের উৎপাদনক্ষমতা কমে গেছে। পাশাপাশি, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে দিনে অন্তত তিন ঘণ্টা পানির উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই কার্যালয়ের আরেক প্রকৌশলী বলেন, একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, নতুন নতুন ভবন হচ্ছে, আর পানির চাহিদা বাড়ছে। অপরদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশই নিচে নামছে, পানির উৎপাদনও কমছে। পাশাপাশি বৃষ্টিপাত কম। ভূমির ওপর কংক্রিটের আচ্ছাদন বেড়ে যাওয়ায় পানির রিচার্জ কম। আমরা পাম্প বসানোর নতুন জায়গা পাচ্ছি না আর সরকারের নীতি হচ্ছে তারা পাম্পের জন্য জায়গা কিনবে না।

তিনি আরো বলেন, আমরা স্থানীয় কাউন্সিলরদের কাছে নতুন পাম্প বসানোর জায়গা চাচ্ছি, কিন্তু তারা দিচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের কার্যালয়ের সামনে একটি পাম্প বসাচ্ছি। তিনি আরো জানান, বর্তমানে পানির স্থির স্তর ২৬০-২৮০ ফুট নেমেছে আর পানি উঠানো হচ্ছে ৯৫০-১০০০ ফুট নিচ থেকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ওয়ার্ডের ৭০ ভাগ এলাকার মানুষ নিয়মিত পানি পান না। আমরা অনেকদিন ধরে সমস্যায় আছি। আমি এ সমস্যা সমাধানে তাদের সঙ্গে বসবো। পাশাপাশি আমরা বারিধারা জে ব্লকের মসজিদের পাশে নতুন পাম্প বসানোর একটি জায়গা দেবো।

এ বিষয়ে ৮ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা খান বলেন, পানির উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমরা নয়ানগর ও আমাদের কার্যালয়ে বোরিং করে নতুন পাম্প বসাচ্ছি। আশাকরি নতুন পাম্প বসানো হলে পানির সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে। এখন আমরা পানির রেশনিং করে চালাচ্ছি।

এদিকে কুড়িল বিশ্বরোডের বড়বাড়ি এলাকার মো. মীর কামরুল হাসান বলেন, আমাদের এলাকার পানির সমস্যা প্রকট। গত ১০ দিনের মধ্যে একবার মঙ্গলবার রাতে পানি এসেছিল। বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারের কাছে একটি পাম্প আছে, সেখানে সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি। এখনও সমস্যার সমাধান হয়নি।

ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে আমরা বোরিং করে পাম্পগুলোতে আরও পাইপ বসাচ্ছি। এ কাজ শেষ হলে আশা করা যায়, পানির সংকট আর থাকবে না। বর্তমানে আমাদের ৮০০টিরও বেশি পাম্প রয়েছে। এর মধ্যে ১০০টির বেশি পাম্পে বোরিং করানোর কাজ হচ্ছে। এই কাজ শেষ হলে আশা করা যায় নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে পানির সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া বেশ কিছু নতুন পাম্প বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। জায়গা পেলে আমরা আরও কিছু পাম্প বসাব।
ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, তাদের দৈনিক পানির চাহিদা ২৬৫ কোটি লিটার। এর ৬৪ শতাংশ আসে ভূগর্ভের পানি থেকে। পানির স্তর বেশ নিচে চলে যাওয়ায় প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। রূপগঞ্জের গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে আসবে বলে আশাবাদী তারা।

এদিকে, মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। শোধনাগার ও পানির লাইনের নির্মাণকাজ শেষে কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে সেটি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে নিতে সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি ওয়াসা। এতে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহূত থাকছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না ওয়াসা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, ঢাকা শহরে চাহিদার ৮০ শতাংশ পানি ভূর্গভস্থ থেকে মেটায় ওয়াসা। এতে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে কমতে থাকলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পদ্মা নদী থেকে ঢাকায় পানি সাপ্লাই দেওয়ার যে প্রকল্পের কাজ চলছে, তা শেষ করতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।



© দিন পরিবর্তন