logo

রেলে বড়সড় নাশকতার ছক

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:14 Dec 2023, 02:52 PM

রেলে বড়সড় নাশকতার ছক


মো. বাবুল আক্তার:

নাশকতাকারীদের টার্গেট হয়ে উঠছে রেলপথ। ইতোপূর্বে হরতাল-অবরোধ কিংবা যে কোনো সহিংস ঘটনায় লাইন উপড়ে ফেলাসহ স্টেশন ও ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এবার রেল লাইন কেটে রেখে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটানো হলো। এই নাশকতামূলক রেল দুর্ঘটনার কেন্দ্র গাজীপুরের ভাওয়াল। লাইন থেকে ছিটকে গেছে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। এতে নিহত ১ ও আহত হয়েছেন ১০ জন। গতকাল বুধবারের এই নাশকতায় একসাথে বহু মানুষকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র ছিল বলে অভিযোগ প্রশাসনের।

এদিকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর ডাকা হরতাল কিংবা অবরোধের মধ্যেই ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে রেল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে হরতাল-অবরোধের সময় যাত্রীবাহী ট্রেন, রেলপথ, রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। গত ২৯ নভেম্বর থেকে পালাক্রমে বিরোধীদলগুলোর হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই ট্রেন চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। নাশকতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে নাশকতার ঘটনা ঘটছে। এরমধ্যে কয়েকটি নাশকতার ঘটনায় যাত্রীদের জন্য ‘ভয়ংকর’ হয়ে উঠেছে ট্রেনযাত্রা।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশনের কাছে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেলপথে ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ষড়যন্ত্র ছিল বড় নাশকতার, এমন অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনের। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মুহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেছেন, নাশকতা সৃষ্টির জন্য দুর্বৃত্তরা রেলপথের একটি অংশ কেটে রেখেছিল। ট্রেনটি ওই স্থানে পৌঁছালে ইঞ্জিন ও চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়।


ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ইঞ্জিন ও চারটি বগি পড়ে ছিল রেললাইনের পূর্ব দিকে। বাকি বগিগুলো লাইনের পশ্চিমে পড়ে ছিল। সবশেষ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি এক্সকাভেটর মেশিনের সাহায্যে দুটি বগি লাইন থেকে সরানো হয়। এ ছাড়া এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় উদ্ধারকারী ট্রেন। উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

এর আগে, ১৫ নভেম্বর মধ্যরাতে টাঙ্গাইল রেলওয়ে স্টেশনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের ৩টি বগি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ১৬ নভেম্বর দিনাজপুরের বিরামপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রেলপথে আগুন ধরিয়ে দেয় নাশকতাকারীরা। তার আগে গাজীপুরের মাটিকাটা রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

গত ৬ নভেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে টায়ার জ্বালিয়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বিক্ষোভ করে। দুষ্কৃতকারীরা জয়দেবপুর-টঙ্গী স্টেশনের মাঝামাঝি ধীরাশ্রম এলাকায় অগ্নিসংযোগ করে। ১ নভেম্বর ঈশ্বরদীর লোকোশেড এলাকায় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। ওই দিন দুপুরের দিকে ট্রেনটিতে পেট্রোলসহ পাথর ও ইট ছুড়ে মারা হয়। এতে ট্রেনের গøাস ভাঙাসহ বেশ কয়েকটি কোচের ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির জানান, রেল সাধারণ মানুষের পরিবহন। আমরা সাধারণ যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্রেন চালাচ্ছি। কিন্তু হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে রেলে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। যাত্রীবাহী কোচ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রেলসেতুতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। এবার রেল লাইন কেটে রাখা হয়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার পরেও এমন ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত।

তিনি জানান, কিছু ট্রেন বিলম্বে চলছে-তবে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছি। ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে ঝুঁকির মধ্যেই ট্রেন পরিচালনা করছেন। হরতালে চলমান ট্রেনের ভেতর এবং ইঞ্জিন ও গার্ডরুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য অবস্থান করবেন। একাধিক ট্রেনচালক ও গার্ড জানান, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে রেলপথ ও বিভিন্ন স্টেশনে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ নাশকতা চালানো হয়।

ওই সময় মাইলের পর মাইল রেলপথও উপড়ে ফেলা হয়েছিল। ওই সময় নির্বাচন প্রতিহতের নামে সারা দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, যাত্রীবাহী ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যা, ট্রেনের লাইন কেটে ফেলা, ট্রেনে হামলা, ইঞ্জিন পুড়িয়ে দেওয়াসহ নানারকম সস্ত্রাসী কর্মকাÐ চালানো হয়। ওই সময় নাশকতাকারীরা ট্রেন-স্টেশনের অগ্নিসংযোগ ছাড়াও রেল-সংকেত পাঠানোর তার কেটে ও ট্রেনে ককটেল হামলা চালিয়েছিল।

এদিকে, গাজীপুর ভাওয়াল বনখড়িয়া এলাকায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনায় দুই ট্রেন চালক এমদাদুল হক আহমেদ আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

চালক এমদাদুল হক জানান, তিনি নিজে ট্রেন চালক, সবুজ তার সহকারী চালক। রাতে মোহনগঞ্জ থেকে ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ চালিয়ে ঢাকা কমলাপুর স্টেশনে আসতেছিল। গাজিপুর ভাওয়াল স্টেশন পার হয়ে আসলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে তারা আহত হন।

তিনি আরো জানান, দুর্বৃত্তরা ট্রেনের লাইন কেটে রেখেছিল। আহত হওয়ার পর নিচে নেমে সেখানে ছোট গ্যাস সিলিন্ডার দেখতে পাই। আমাদের ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়।

তাদের সহকর্মী মো. ফারুক হোসেন জানান, আহত হওয়ার পর তাদের দু’জনকে প্রথমে গাজিপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের দু’জনকে ঢাকা রেলওয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।

আহত চালক এমদাদুল হকের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সেলিমপুর গ্রামে। বর্তমানে সবুজবাগ মধ্য বাসাবোতে থাকেন। সবুজ মিয়ার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গৌড়িপুর থানার মাওহা গ্রামে। বর্তমানে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনীতে থাকেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, গাজিপুর থেকে ট্রেন দুর্ঘটনায় দুইজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছে। এদের মধ্যে এমদাদুলের বাম পা ও কোমড়ে আঘাত রয়েছে। এবং সবুজের চোখের উপড়ে ও বাম হাতে আঘাত রয়েছে। জরুরি বিভাগে তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের দুর্ঘটনা তদন্তে গতকাল বুধবার দুটি কমিটি করা হয়েছে। রেলওয়ের পক্ষ থেকে একটি এবং গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।


এ ছাড়া, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড কমার্শিয়াল) মোহাম্মদ শফিকুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে দুর্বৃত্তরা নাশকতা সৃষ্টির জন্য ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। ঘটনাটির সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি হরতাল-অবরোধের নামে দেশের সম্পদ নষ্ট করছে, রেলওয়ের সম্পদ নষ্ট করছে। গত কয়েক দিনে বিএনপি-জামায়াত দেশের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন এবং ট্রেনে আগুন দিয়েছে। যেটা তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় করেছিল। ট্রেনে অগ্নিসংযোগকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে এবং তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।



© দিন পরিবর্তন