নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:15 Sep 2022, 06:53 PM
রোড ম্যাপ ঘোষণা ইসির
মহানগর আর জেলা সদরের দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের পাশাপাশি প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরায় নজরদারির লক্ষ্য ঠিক করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। এসময় আগামী বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথাও জানানো হয়।
গতকাল বুধবার ইসির এই ‘রোডম্যাপ’ সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক বিভেদ আর প্রশ্নের মোকাবিলা তাদের করতে হয়েছে। তারপরও গত ছয় মাসে ‘কিছুটা হলেও’ আস্থা অর্জনের দিকে ইসি এগিয়ে বলে তার বিশ্বাস।
জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর সাড়ে ১৫ মাস; এই সময়ের মধ্যে সব দলের আস্থা অর্জন করে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশার কথাই বললেন এই নির্বাচন কমিশনার। অসুস্থ থাকায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। তাই জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান রোডম্যাপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেন।
তিনি বলেন, রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্য একটাই-অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা। আমরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন এবং আমরা অনেক আস্থার ঘাটতির মধ্যে আছি। আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ দিয়েছি, আমরা কিছুটা হলেও আগের থেকে আস্থা অর্জনে এগিয়ে গেছি। এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে নিজেদের ‘জবাবদিহিতা ও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাও’ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এ নির্বাচন কমিশনার।
এসময় নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা এমিলি বলেন, পরিকল্পনা ধরেই এগিয়ে যাব আমরা। সবার সহযোগিতা পেলে অংশগ্রহণমূলক ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবো। ‘বাস্তবভিত্তিক ও সময়ভিত্তিক’ এ রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে ইসির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, সেজন্য অংশীজনদের সবার সহযোগিতাও দরকার হবে।
এসময় নির্বাচন কশিমনার মো. আলমগীর বলেন, এ কর্মপরিকল্পনায় সবার মতামত রাখার চেষ্টা করেছি আমরা। যেসব বিষয় আমাদের আওতায় রয়েছে তা রাখা হয়েছে। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সুপারিশগুলো রাখা হয়নি। রোডম্যাপের চ্যালেঞ্জগুলো ধরে, সেগুলো মোকাবিলা করে সব কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। ভোটের এখনো এক বছর চার মাস বাকি। অনেকে ইসি নিয়ে আস্থাহীনতায় থাকলেও আগামীতে কর্মকাণ্ড দেখে আস্থাশীল হবেন।
কর্মপরিকল্পনায় সুষ্ঠু নির্বাচন চ্যালেঞ্জ, মোকাবিলায় ইসি করণীয়, দলগুলোর কার্যক্রম খতিয়ে দেখা, নির্বাচনের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কখন কোন কাজ করবে তার সম্ভাব্য সময়সূচিও নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি।
আগামী নির্বাচনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সে বিষয়েও বিস্তারিত তুলে ধরেছে নির্বাচন কমিশন। এগুলো হলো; নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি; নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন; ব্যবহূত ইভিএমের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি; অর্থ ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ; নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; সব রাজনৈতিক দল কর্তৃক আচরণবিধি অনুসরণ; নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থক, পুলিশ, প্রশাসন কর্তৃক কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হওয়া; জালভোট, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই রোধ; এজেন্ট বা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে অবাধ আগমন; ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি; নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান; পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিতকরণ; পর্যাপ্ত সংখ্যক নির্বাহী ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিতকরণ; নিরপেক্ষ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োজিতকরণ।
এসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের উপায়ও বের করেছে নির্বাচন কমিশন। এগুলো হলো; বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনি আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশজন করেছেন তা বাস্তবায়ন; সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনি প্রচারকার্য নির্বিঘ্ন করতে পারে সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখা; সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা; প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থক দ্বারা প্রার্থী, সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ না করা। এমন হলে আইন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ; নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা, বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া; মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন, জননিরাপত্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, আনসার ও ভিডিপির প্রধানদের সঙ্গে সভা করে তাদের অধীন কর্মকর্তা যারা নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবেন তারা যেন আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন সে বিষয়ে অধিনস্তদের নির্দেশ দেওয়া; প্রত্যেক ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন; ভোট কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন; ইভিএমের ব্যবহার সবোর্চ্চ ১৫০ আসনে সীমাবদ্ধ রাখা। শুধুমাত্র মেট্রোপলিটন ও জেলা সদরের আসনগুলোতে ব্যবহার করা; নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগ; নির্বাচনি আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ, ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ; আরপিও ও নির্বাচনি আচরণ বিধিতে কতিপয় প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা; রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যতদূর সম্ভব নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া; রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পূর্বেই শুরু করা যাতে যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়; যেসব প্রিজাইডিং/সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বিষয়ে প্রার্থীর যুক্তিসংগত আপত্তি থাকবে তাদের নিয়োগ না দেওয়া; দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও তাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা; গণমাধ্যম কর্মী নিয়োগ ও তাদের জন্যও ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করা; নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অনীহা, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা; প্রার্থীদের জনসভা করার জন্য স্থান, তারিখ, সময় সিডিউল করে দেওয়া।
তবে ইভিএম বিষয়ে ইসি বলছে, এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে ইভিএমে কারচুপির প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। আর এই মেশিনে কারচুপি সম্ভব নয়। কেবল মনস্তাত্বিক ধারণা থেকে ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ করা হয়। সংলাপে ১২ দল সরাসরি ও ১১টি শর্ত সাপেক্ষে ইভিএম চেয়েছে, আর ৬টি দল সরাসির বিপক্ষে অবস্থা নিয়েছে বলে রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে।
রোডম্যাপে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নিধারণে নতুন একটি নীতিমালা করা হবে। যার ভিত্তিতে জিওগ্রাফিক্যালি ইনফরমেশন সিস্টেম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৩ সালের মার্চে আসনগুলোর সীমানা বিন্যাসের খসড়া প্রকাশ করা হবে। এপ্রিলে সেই খসড়ার ওপর দাবি আপত্তি নিয়ে মে মাসে সেগুলো নিষ্পত্তির পর জুন মাসে ৩০০ আসনের পরিবর্তিত সীমানার গেজেট প্রকাশ করা হবে।
এছাড়া বর্তমানে হালনাগাদের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালের ২ মার্চ হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করা হবে। আর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে প্রকাশ করা হবে ৩০০ আসনের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে ইসি। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালের জুনে কাজ হাতে নেওয়া হবে। জুলাইয়ে খসড়া প্রকাশ, আগস্টে সেই খসড়ার ওপর দাবি আপত্তি নিয়ে তা নিষ্পত্তি করা হবে। এরপর ভোটগ্রহণের ২৫ দিন আগে ভোটকেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন।
নতুন রোডম্যাপে বলা হয়, নিবন্ধিত দলগুলোর কার্যক্রম খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হবে চলতি সেপ্টেম্বরেই। এক্ষেত্রে সব তথ্য পর্যালোচনা করে ২০২৩ সালের মে মাসে কোন কোন দল নিবন্ধন বহাল থাকবে সেই সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। আর একই বছর জুনে প্রকাশ করা হবে নিবন্ধিত দলগুলোর চূড়ান্ত তালিকা। এর আগে মে মাসে দেওয়ার হবে নতুন দলের নিবন্ধন। এছাড়া ২০২৩ সাল থেকেই নেওয়া হবে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ, সফটওয়্যার প্রণয়ন, প্রচার কার্যক্রম ও পর্যবেক্ষক যাচাই-বাছাইকরণ কার্যক্রম।
ইতোমধ্যে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড তদারকি এবং তা চূড়ান্তকরণের জন্য নির্বাচন কমিশনারদের নেতৃত্বে বিষয়ভিত্তিক আলাদা আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সবার মতামতের আলোকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে তোলা সম্ভব হবে বলেও রোডম্যাপে উল্লেখ করেছে ইসি।
একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী, সেই সময় ধরে পরবর্তী পাঁচ বছর মেয়াদ ধরলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ইতোমধ্যে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের ডিসেম্বরে শেষ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
© দিন পরিবর্তন