logo

লড়াই হতে পারে দুই জোটে

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:08 Dec 2023, 03:35 PM

লড়াই হতে পারে দুই জোটে


এম এ বাবর

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে নেই বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট। তবে নতুন কিছু দল নিয়ে গঠিত জোটের সঙ্গে হতে পারে এবার মহাজোটের ভোটের লড়াই। এদের এক পক্ষে থাকবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট ও জাতীয় পার্টি। অন্য পক্ষে থাকতে পারে নতুন নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টিসহ কয়েকটি দলের নতুন জোট। এই জোটের সম্ভাব্য নাম ‘জাতীয়তাবাদী জোট’।

মহাজোটের সূচনা হয়েছিল ২০০৬ সালে জটিল এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। গত তিন নির্বাচনে লড়াই হয় সমঝোতা ও আসন ভাগাভাগির মাধ্যমেই। এবারও বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্যেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে বেশ কিছু আসনে সমঝোতার বিষয়টি নিয়েই এগোচ্ছিল আওয়ামী লীগ। তবে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বের টানাপোড়েনে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা ভোট থেকে দূরে থাকার পর সমীকরণ পাল্টাতে পারে বলেই মনে করছেন অনেকে।

এদিকে এবারও আওয়ামী লীগের সাথে জোটের শরিক-মিত্ররা নির্বাচনে ছাড় চায়। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগির বিষয়ে এখনও কিছু খোলাখুলি বলতে চাচ্ছে না। এছাড়া বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনে আসা অন্য দলগুলোও আশার আলো দেখছে ‘যদি কিছু আসন জোটে’। এবারের নির্বাচনের নতুন দল তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, সুপ্রিম পার্টিসহ ছোট দলগুলোর প্রত্যাশা, অনেকের সংসদ সদস্য হওয়ার ভাগ্য খুলতে পারে যদি আওয়ামী লীগ কিছুটা ছাড় দেয়।

এমনও বেশ কয়েকটি দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে যার বিগত কোনো নির্বাচনে কোনো প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি। এ দলগুলোও স্বপ্ন দেখছে তাদের দল থেকে ২/১ জন সংসদ সদস্য হবে। তারা অনেকে আওয়ামী লীগ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই নির্বাচনে এসেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

তবে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে জোটের দলগুলোর বিভিন্ন সময়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর সাথে বৈঠক হলেও এখনও আসন ভাগাভাগির বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানায়নি আওয়ামী লীগ।

জাতীয় পার্টি বলছে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের মনে মনে সমঝোতা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাতীয় পার্টি এবারের নির্বাচনে জোট-মহাজোট নয়, নিজস্ব দলীয় প্রতীকে অংশ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কোনো সমঝোতা হলে সেটা মনে মনে হবে। আসন ভাগাভাগিরও কোনো প্রস্তাব দেয়নি আওয়ামী লীগ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই জয় নিশ্চিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে মহাজোট ও মিত্র দলগুলো প্রায় ৮০টি আসন চেয়েছে। যা পেলে তারা খুশি থাকবে।

এর মধ্যে জাতীয় পার্টি ৩৫টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি, জাসদ (ইনু) ৫টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ২টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২টি, এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল -জাসদ (বাদল) ১টি আসন চেয়েছে। এছাড়া তৃণমূল বিএনপি ৫টি, বাংলাদেশে ন্যাশনালালিস্ট মুভমেন্ট-বিএনএম ৫টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ২টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট ১টি, বাংলাদেশে তরিকত ফেডারেশন ২টি, ইসলামি ঐক্যজোট ২টি, জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু) ২টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ৫টি, গণফোরাম ২টি, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ১টি আসনের প্রত্যাশা করছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত তিন সংসদ নির্বাচনের দুটিতে জোট সঙ্গীদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রার্থী দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৪ নির্বাচনে জোট সঙ্গীদের নৌকা প্রতীক না দিলেও আসন সমঝোতা হয় এবং আওয়ামী লীগের সমর্থনে জিতে আসে শরিক দলগুলো।

২০১৪ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আগ্রহ অনুযায়ী ৩৪ আসনে ছিল না নৌকার কেউ। লাঙ্গলের প্রার্থীরা জয় পান সেসব আসনেই। ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জন করা দশম সংসদ নির্বাচনে যখন ভোট নিয়ে নানামুখী তৎপরতা, সে সময় রওশনের অবস্থানের কারণেই জাতীয় পার্টির একটি অংশ শেষ পর্যন্ত ভোটে যায়।

শরিক দলগুলোর এবারের প্রত্যাশা আগের নির্বাচনের থেকেও বেশি। যেহেতু বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল নির্বাচনে নেই এবং নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের ওপর যে দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে সেটাকে সুযোগ হিসেবে কিছুটা কাজে লাগাতে চায় শরিক দলগুলো।

এমনকি যেসব দল বিগত কোনো নির্বাচনে একটি আসনেও জয় পায়নি সে দলগুলোর নেতারাও স্বপ্ন দেখছেন সংসদ সদস্য হওয়ার। রাজনৈতিক এ সংকটে এটিকে বড়ধরনের সুযোগ হিসেবে মনে করছেন তারা। শুধু তাই নয়, বিএনপির রাজনীতি করে যারা বিগত দিনে কোনো আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ারও সুযোগ পায়নি তারা দল পরিবর্তন করে বিএনএম, তৃণমূল বিএনপি সহ দলগুলোতে গিয়ে তারাও এমপি হওয়ার সুযোগটি নিতে চাচ্ছেন।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার মহাজোট শরিক দলগুলোকে ৩৯টি আসন দিয়েছিল, যার মধ্যে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয়েছিল ২৬টি আসন। এছাড়া জাসদ (ইনু) ৩টি, বিকল্পধারা ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি, তরিকত ফেডারেশন ১টি এবং জেপিকে ১টি আসন দেওয়া হয়।
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৮ আসনে, জাতীয় পার্টি ২২ আসনে এবং বিএনপি জোট ৮টি আসনে জয়ী হয়। আর ৩ আসনে জয় পায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এছাড়া ৯টি আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগের জোটের অন্য দলগুলো।
আওয়ামী লীগের জোট হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের দলগুলোর মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাসদ ২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, বিকল্প ধারা ২টি, তরীকত ফেডারেশন ১টি জিতেছিলো। এর বাইরে জাতীয় পার্টি-জেপি বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে একটি আসনে জিতেছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। বাকি আসনগুলোতে নৌকা প্রতীকে দলীয় প্রার্থী ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এবার আওয়ামী লীগ বেশিরভাগ আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়ায় শরিক দলগুলো কীভাবে অংশ নেবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া নতুন অংশ নেওয়া তিনটি দলকেও কিভাবে আসন দিবে সে বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এরইমধ্যে হাসানুল হক ইনুসহ জাসদের ৯১ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির ৩৩ জন, বিকল্প ধারার ১৪ জন, তরিকত ফেডারেশনের ৪৭ জন বিভিন্ন আসনে প্রার্থী হয়েছেন।

বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, আমরা এবার জোটের কাছে ৫টি আসন চেয়ে জমা দিয়েছি। তবে এখন চূড়ান্ত করেনি। মনে হয় জাতীয় পার্টির সঙ্গে বসার পর আমাদের ১৪ দলের আসন চূড়ান্ত করবে। আমাদের দল থেকে চট্টগ্রাম ২ ও ১ এর মধ্যে যেকোন একটা, কুমিল্লা ৮ ও ৯ যেকোন একটা, চাঁদপুর ৫ ও ৬ এর যেকোন একটা এবং চট্টগ্রাম-৫ আর ময়মনসিংহ সদরের একটি আসন চেয়েছি।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, রাজনৈতিক কারণেই জোট থাকছে, সেটা বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা না আসুক। আমরা এবারে গত নির্বাচনের থেকে বেশি আসন প্রত্যাশা করছি মহাজোট থেকে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সামনের দিনগুলো খুব সুখময় হবে না। অর্থনৈতিক স্যাংশনসের কথাও আসছে। সুতরাং জোট সঙ্গীদের লাগবে। এজন্য আমাদের চাহিদাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে আওয়ামী লীগকে।

তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, জোট নেত্রী পরিষ্কার বলেছেন, বিএনপি এলেও জোট থাকবে, না এলেও জোট থাকবে। এখনো যেহেতু ভিন্ন কোনো ঘোষণা দেননি। তাহলে আগের কথাই বহাল আছে। তাই আমরা ভিন্ন কিছু ভাবছি না।

জোট নেতাদের আশা জোটের শরিকদের আসনসহ নতুন মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ শুধু সময়ের অপেক্ষা। একইভাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারাও বলছেন, এই তালিকা পরিবর্তনসহ জোট শরিকদের নিয়ে নতুন তালিকা শিগগির আসছে।

গত নির্বাচনে ১৪ দলের চার শরিককে ১০টি আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। ওয়ার্কার্স পার্টির জেতা তিনটি আসন হচ্ছে ঢাকা-৮, রাজশাহী-২ ও সাতক্ষীরা-১। জাসদের আসন তিনটি কুষ্টিয়া-২, ফেনী-১ ও বগুড়া-৪। এছাড়া জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর-২ ও তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনের এমপি।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ এ দুটি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ দুটি আসনেই আওয়ামী লীগের ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছে। বরিশাল-২ এ আওয়ামী লীগের তালুকদার মো. ইউনুস এবং বরিশাল-৩ এ রয়েছেন আওয়ামী লীগের সরদার মো. খালেদ হোসেন ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপু।

কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগ কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। তবে কুষ্টিয়া-২ আসনে ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এর আগে ফেনী-১ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোট করে দু'বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন।

১৪ দলের জোটের আরেক শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) একমাত্র সংসদ সদস্য দলটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার পিরোজপুর-২ আসনে কানাই লাল বিশ্বাসকে প্রার্থী করছে আওয়ামী লীগ।

বিকল্পধারার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নানের লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে ফরিদুন নাহার লাইলী এবং মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মহিউদ্দিন আহমেদকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারীর চট্টগ্রাম-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন খাদিজাতুল আনোয়ার।



© দিন পরিবর্তন