নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:31 Aug 2022, 06:42 PM
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা
২৫ আগস্ট ২০২২, সকাল দশটা। আমার ছুটা বুয়া হালিমা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘খালা, যার যায় সে-ই বোঝে কী হারালো। মুহূর্তে মেয়েটা নাই হয়ে গেল। ’ ওর কথা শুনেই বুঝতে পারি গতকালের ঘটনার কথা বলছে। ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত নামকরা একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ২২ আগস্ট আত্মহত্যা করেছে। নিজেদের বাসস্থানের ১২ তলা ভবনের ছাদ থেকে সে লাফিয়ে পড়ে। ছাদে ওঠার পর লাফ দেওয়ার আগে ওকে অনেকেই দেখে, সবাই নিষেধ করে। কিন্তু সে একপর্যায়ে ঠিকই লাফ দেয়।
একটু পেছনে যাই। সময়টা ২০০২ সাল। আমার বড় সন্তানকে নিয়ে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাই প্রথম শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা বলতে তারা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে সাক্ষাৎ করে একটা ফর্ম দেন। ফর্ম পূরণ করে জমা দেওয়া হয়। পরে লটারির মাধ্যমে যারা ভর্তির সুযোগ পায় তাদের ভর্তি করায়। যদিও এই লটারি সিস্টেমকে ব্যক্তিগতভাবে মোটেই বিশ্বাস করি না। লটারি হলে সেটা পাবলিকের সামনেই হবে। বলে রাখা ভালো সব শিক্ষার্থীদের তারা ফর্ম দেন না। সাক্ষাতে যে মৌখিক জিজ্ঞাসা হয় তার ওপর নির্ভর করে, শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে তারপর যাদের প্রতিষ্ঠানের নিয়মে পাস বলা চলে তাদের ফর্ম দেন। যথারীতি আমি আর আমার হাজবেন্ড মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত। মেয়েকে কয়েকটা প্রশ্ন করে, সে জবাব দেয়। মেয়ে একটা মিশনারি স্কুলে প্লে ক্লাস পড়ে। কিন্ডারগার্টেনে ওকে নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করাতে নিলে তারা বলে, ও তো নার্সারির সব পড়াই পারে, ওকে কেজি ক্লাসে দিন। আমরা তা-ই করি। তার মানে বয়স ও ক্লাস অনুপাতে সে ২০০৩ সালে ক্লাস ওয়ানে পড়ার কথা। নার্সারি ক্লাস না পড়ার কারণে তাকে ২০০২ সালেই প্রথম শ্রেণির ভর্তিযুদ্ধে নামতে হয়।
ভর্তি সাক্ষাৎকারে সে মৌখিক সবই পারে। উনাদের নিয়ম অনুযায়ী দাঁত দেখা হয়, মেয়ের দাঁত তখনও পড়েনি। মাথার উপর দিয়ে কান ধরতে বলে, সে সেটাও পারে। যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তিনি বারবার মেয়ের পা থেকে মাথা দেখছেন। মেয়েকে নিয়ে পাশের রুমে গেলেন, পাশের রুমের উনিও মেয়ের পা থেকে মাথা দেখেন। এই দেখার কারণ হলো মেয়ের উচ্চতা দেখা। অনেক ভেবে তিনি ফর্ম দিলেন। ফর্ম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি উনাকে বললাম, যতবার মেয়ের পা থেকে মাথা দেখেছেন তার মাঝে একবার যদি অরিজিনাল চোখ দিয়ে আমাদের দিকে তাকাতেন, বুঝতেন ও কোন পরিবারের সন্তান। ঘটনা খুলে বলি। আমি লম্বায় পাঁচ ফিট সাড়ে ছয় ইঞ্চি, আর আমার হাজবেন্ড লম্বায় পাঁচ ফিট সাড়ে আট ইঞ্চি। আমাদের সন্তান কি দুই ফিট হবে? (সব আল্লাহর দান)।
সন্তান ভর্তির সুযোগ পায়নি, আমার কোনো আফসোসও নেই। এই ঢাকা শহরের আরেকটা নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন আমার ননাসের স্বামী। অনেকে আমাকে বলেছে মেয়ের জন্যে উনাকে বলতাম উনি যেন সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন। সবসময় মেয়েদের বলেছি, নিজের যোগ্যতায় যেখানে ভর্তির সুযোগ পাবে সেখানেই পড়বে। বরং অন্যদের বাচ্চার জন্যে সুপারিশ করি, স্কুল-কলেজে অনেক বাচ্চাকে সুপারিশ করে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু নিজের সন্তানের জন্য কারও কাছে যাইনি।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে সবাই আবার ভর্তিযুদ্ধে নামে কিন্তু আমি নামিনি। একইভাবে ছোট মেয়ের ক্ষেত্রে আমি আর ওই ধরনের প্রতিষ্ঠানের গেটেও যাইনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান অনেক কিন্তু আসল হলো শিক্ষার্থীর মেধা। একই বোর্ডে একই প্রশ্নপত্রে সব শিক্ষার্থীই বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে পাস করে। তবে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অন্যরকম হবে?
বড় মেয়ে যখন অষ্টম শ্রেণিতে, তখন একজন ইংরেজি শিক্ষকের কাছে যাই ওকে প্রাইভেট পড়াতে। স্যার জানান এই ব্যাচ পুরোটা তথাকথিত নামকরা স্কুলের। ও একা ওদের সাথে...। আমি বললাম, স্যার আমি মেয়েকে অষ্টম শ্রেণি উপযোগী শিক্ষা দিতে এনেছি, ওরাও অষ্টম শ্রেণির, সমস্যা হবে না। তবে যখন ওদের রচনা বা প্যারাগ্রাফ লিখতে দেবেন, ওকে ওর সিলেবাস থেকে দেবেন। স্যার শুনে খুবই খুশি হলেন। মেয়েকে পড়তে দিয়ে আমি বাইরে বসে বসে পত্রিকার লেখা লিখতাম। ওই তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরা যখন শুনতেন আমি অন্য স্কুলের, তারা আমার দিকে চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার মতো তাকাতেন। পাত্তাই দিতাম না।
সব প্রাইভেট বা কোচিংয়ের শিক্ষক এক নন। আপনাদের উচিত সব শিক্ষার্থীর সাথে একই আচরণ করা। আপনারা ক্লাসে নামকরা প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেন, আপনারা কি জানেন না এই শিক্ষার্থীদের কে বা কারা তৈরি করেছে? দেশের বা শহরের প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ওদের তৈরি করে। এরপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে সেসব শিক্ষার্থীকে নিয়ে ভালো ফলাফল দেখিয়ে তারা নামকরা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পায় আর আপনারা অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে তাচ্ছিল্য ভাষায় কথা বলেন। যে কোনো প্রাইভেট বা কোচিংয়ের শিক্ষক বলতে পারেন কোন যুক্তিতে আমি এসব বললাম। মনে রাখবেন আমি প্রমাণ ছাড়া কাজ করি না। নিজের পেশাগত কারণে হোক আর একজন অভিভাবক হিসেবে হোক, আমি প্রায়ই কোচিং সেন্টারের সামনে বা ক্লাসের পাসে বসে থাকি।
অমন নামকরা প্রতিষ্ঠান হোক বা প্রাইভেট বা কোচিংয়ের শিক্ষক হোক না কেন। শতজনের প্রশ্নের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে আমি প্রস্তুত। কারণ সত্যের জোর হলো আসল জোর। নামকরা (ছেলেদের) এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলার স্যারের কাছে আমার মেয়েসহ ১০ জনের একটা ব্যাচ নিয়ে পড়াতে যাই। ওরা সবাই একই স্কুলের। স্যারের সাথে আমাদের সময় মেলে না বলে রাত নয়টা থেকে দশটা উনার বাসায় পড়াতে যাই আমরা। স্যারকে শুধু বলেছিলাম, ওদের আপনি ব্যাকরণটা বুঝিয়ে দিন। গতানুগতিক পড়া লাগবে না। স্যার তা-ই করেন। স্যারের কাছে পড়ে আমার মেয়ে বলেছিল— মা, স্যারের তো বয়স হয়েছে। উনার রক্তে রক্তে ব্যাকরণ, স্যার চলে গেলে কে এমন করে শেখাবে। স্যারের উচিত উত্তরাধিকার কাউকে তৈরি করে দিয়ে যাওয়া। শিক্ষক বলে কাদের, তা বোঝাতেই এই ঘটনা বলা।
এবার আসি অন্য এক বিষয়ে। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় মেয়ের প্রশ্নের জবাব লেখার মান তেমন ভালো না। একজন স্যারের কাছে দুইটা পরীক্ষা দেওয়া হয়। উনি বললেন, ও সবই পারে কিন্তু সাজাতে গিয়ে সমস্যা করে। অতঃপর স্যার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার দুটো খাতা ওকে দেখায়। ও সেগুলো দেখে, বুঝে, পরের পরীক্ষায় সে অনেক ভালো করে। এবং এসএসসি পরীক্ষায় ও ভালো করে। আপনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নাকি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের শিক্ষক সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হলো আপনি একজন শিক্ষক। আপনার কাছে ওরা শিখতে এসেছে।
আমি প্রায়ই প্রয়োজনে বা দায়িত্বে হোক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে যাই। শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সাথে কথা বলি, ওনাদের কথা শুনি। সেদিন বাসায় এসে হাজবেন্ডকে বলি, জানো কোনো জায়গায় যদি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩/৪ জন অভিভাবক থাকেন আর অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২/৩ জন অভিভাবক থাকেন। নামকরা-রা মনে করে তাহারা হাতি আর অন্যরা পিঁপড়ে। অনেক অভিভাবক বলেন, আপনাকে অনেক জায়গায় দেখি। আমি বলি— হ্যাঁ, দেখেন কখনও অভিভাবক হিসাবে কখনও পেশাগত কারণে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে, বা কী অবস্থায় আছে তা প্রায় সকলেরই জানা। কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার পরও প্রায় সব বিষয় বাইরে পড়তে হচ্ছে? এমনও অনেক আছে এক একটা বিষয় দুজন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, কিন্তু কেন? ২০০৮ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি হাতে পেয়ে আমরা খুশিতে গদগদ হয়েছিলাম। আজ ২০২২ সাথে এসে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে কতবার যে ডোবাতে হলো, কতবার যে ভাসাতে হলো তা আমাদের গুণিজনরাই ভালো জানেন। অতঃপর শুনলাম সম্ভবত ২০২৪ সাল থেকে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যিক বিভাগ থাকবে না। কলেজে গিয়ে ভাগ হবে। বলতে হয় যাহা লাউ তাহাই কদু। আবার এটাও বলা যায় মন্দের ভালো। যে যুদ্ধ অষ্টম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় হতো, সে যুদ্ধ দু’বছর কমে এসএসসির পরে হবে।
সবাই চায় তার সন্তান ভালো করুক, তার সন্তান প্রথম দ্বিতীয় হোক। কিন্তু আমি তা কখনও চাইনি। চেয়েছি আমার সন্তান তার মেধাকে বিকশিত করে কাজে লাগাক। বিজ্ঞান বিভাগে থাকলে উচ্চশিক্ষার জন্যে সে যে কোনো পথ বেছে নিতে পারে বলে, প্রায় অনেকেই চায় তার সন্তানকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে। কিন্তু আসনসংখ্যা বলে একটা কথা তো আছে। বিগত দিনে দেখে এসেছি দেখছি অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেই তথাকথিত নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখের হাসি চলে যায়। ওষুধ ছাড়াই চিনি রোগ কমে যায়। এর একটাই কারণ, সন্তানকে বিজ্ঞান বিভাগ পেতেই হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগের আসন সীমিত। অনেক অভিভাবক নিজেই বলেন, এবার আমাদের যুদ্ধের বছর। শুনি আর হাসি আমি।
আগেই বলেছি, আমি সন্তানদের প্রথম বা দ্বিতীয় হতে বলি না। পড়ার চাপ নেই এটা বলা যাবে না। উচ্চশিক্ষার জন্যে ভালো কোথাও ভর্তি হতে হলে তাকে ভালো করতে হবে। ছোট মেয়ে এবার একাদশে পড়ে। ও এসে বলে, মা মেয়েরা প্রেম করার সময় কই পায় বুঝি না। কলেজ, কোচিং করে বাসায় এসে মনে হয় নিজের নাম ভুলে যাই। আর ওরা দেখি মোবাইল টেপে আর টেপে। আমি মেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করি বলে ওরা আমায় সব বলে। ক্লাসের কোন মেয়ে কোচিংয়ের কোন মেয়ের বয়ফ্রেন্ড কে, কার সাথে কে কফি খেতে যায় সবই বলে। আমি গল্প করি ওদের সাথে।
আমাদের গতিপথ বদলে দেওয়ার আরেক যন্ত্র হলো মোবাইল। অনেক অভিভাবক বুঝে বা না বুঝে সন্তানের হাতে তুলে দেন একটা স্মার্ট মোবাইল। সেদিন এক শিক্ষক বললেন, ‘এই এক মোবাইল ফোনে রয়েছে ধর্মীয় বাণী আবার এই একই মোবাইল ফোনে রয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী দেখার কিছু। চিন্তা কর তুমি কোন দিকে যাবে ।’
লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
© দিন পরিবর্তন