নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:02 Aug 2022, 06:35 PM
সংকট মোকাবিলায় তৎপর সরকার
রপ্তানি ছাড়া দেশের অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই রয়েছে চাপের মুখে। একদিকে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, কমছে রেমিটেন্স, রাজস্ব আহরণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে ডলারের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি চলছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। যদিও সব সংকট মোকাবিলায় বেশ তৎপর সরকার। এজন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। তবে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি চলমান সংকট শিগগির কাটবে না বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা। সংকট কাটাতে দ্রুততম সময়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য নীতিনির্ধারকদের পরামর্শও দেন।
করোনা অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই শুরু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব এখনো দৃশ্যমান। বাংলাদেশও প্রভাবমুক্ত নয়। দেশের সংকটগুলো নিরসনে সরকার জ্বালানি সাশ্রয়, আমদানি ব্যয় কমানো ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, উচ্চমূল্যের কারণে বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি আমদানি করে তা ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটা আরো কিছুদিন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। কিছু কিছু খাতে এখনো সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের প্রণোদনাগুলো তুলে দেওয়ার সময় হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। আবার বৈদেশিক মুদ্রার আয় কম হওয়ায় ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি নির্ভর পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। যার ফলে চলতি জুলাইয়ের ২৭ দিনে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কম আমদানি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিমাসে আমদানি ব্যয় প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার।
সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অপ্রয়োজনে অফিসের এসি ও বাতি ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছে। এভাবে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে অফিসের কাজের সময় কমিয়ে আনার বিষয়টিও বিবেচনাধীন। পেট্রোল পাম্পগুলোও সপ্তাহে একদিন বন্ধ এবং দিনে ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের বিষয়েও কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া, রাত ৮টার পর দোকান-শপিংমল বন্ধ রাখাসহ আলোকসজ্জাতেও এসেছে নিষেধাজ্ঞা। যদিও রাজধানীর অনেক জায়গায় মানা হচ্ছে না এই নির্দেশ।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, শুধু দোকান ও শপিংমল ৮টা পর্যন্ত বন্ধ রেখে সরকার কাঙ্ক্ষিত ফল না-ও আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে অফিসগুলোতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের আন্তরিক হতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারকে জ্বালানি সংকটের পরবর্তী ধাক্কা থেকে জনসাধারণকে বাঁচাতে আরো মনোযোগী ও দক্ষ হতে হবে। দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানাবিধ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আরো কিছু নির্দেশনা প্রয়োজনে পরে দেওয়া হবে। অফিস সময় কমিয়ে আনার বিষয়টি চূড়ান্ত নয়।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গায় থেকে কৃচ্ছ্র সাধন, সঞ্চয় বাড়ানো, মিতব্যয়ী হওয়া, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার ও অপচয় কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বারবার। ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। একই সাথে বন্ধ করা হয়েছে দেশের বড় দুটি সার কারখানাও।
একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। গাড়ি কেনা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। মিটিং ভার্চুয়ালি করার নির্দেশনা রয়েছে। আপ্যায়ন ব্যয় কমিয়ে আনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। একইভাবে নিয়মিত বাজার তদারকি ও টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। চলছে এ নিয়ে নজরদারিও।
কিন্তু সরকারের নেওয়া এসব পদক্ষেপকে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সম্প্রতি সিপিডি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেওয়া স্বাগত বক্তব্যে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, চলমান সংকটের চরিত্র স্বল্পমেয়াদি নয়, শিগগিরই এটা যাচ্ছে না। বরং ক্রমে তা স্বল্পমেয়াদি থেকে মধ্য মেয়াদের দিকে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ২০২৩ সালেও এটার চাপ থাকবে। কিন্তু সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এটা দিয়ে মূল সমস্যা ঢাকা যাবে না। তিনি সংকট কাটানোর জন্য দ্রুততম সময়ে স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি- এই তিন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দেন।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, অনেকদিন ধরেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্বস্তিকর অবস্থা ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে আমরা ক্রমে বের হয়ে যাচ্ছি। রপ্তানি ছাড়া প্রায় প্রতিটি সূচকেই অনেক ধরনের চাপ দেখা দিচ্ছে। সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অর্থনীতির এই সংকট আরো প্রকট হতে শুরু করেছে। সারা বিশ্বেই অধিক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ওপরও চাপ পড়ছে। ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে আমরা এই প্রথম এ ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছি। কৃচ্ছ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয় দাবি করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি তথ্যানুসারে, জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। এই হিসাবের সঙ্গে কিন্তু বাস্তবতার অনেকখানি ফারাক রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় তিনি ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি জুলাই পর্যন্ত কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, কোনো কোনো পণ্যের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে; অর্থাৎ বাজারে পণ্যের মূল্য অনেকখানি বেড়েছে। বাজারের এই পরিস্থিতি কিন্তু সরকারি মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের জন্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সেটা কীভাবে হবে, তা বোধগম্য নয়। এই পরিস্থিতিতে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কার্যকর করার পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আহরণ ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য দূর করতে কৃচ্ছ্রসাধন, প্রকল্প ব্যয় কমানোসহ সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই হার দিয়ে সরকার তার বিরাট খরচ পুষিয়ে উঠতে পারবে না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এখনই একটি মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, সংকট কাটাতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে অর্থের অপচয় ও অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ করতে হবে। যতগুলো অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ ঝুঁঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা অতটা খারাপ না হলেও আমাদের এখন সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে।
© দিন পরিবর্তন