নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:21 Feb 2024, 12:37 AM
সর্বত্র নিশ্চিত হয়নি বাংলা ভাষার ব্যবহার
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস আজ। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। আজ বাঙালির হƒদয় যেমন স্বজন হারানোর বেদনায় হাহাকার করে, তেমনি অধিকার আদায়ের আনন্দেও উদ্বেলিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি শোকাবহ হলেও এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পৃথিবীর বুকে অনন্য। কারণ বিশ্বে এযাবৎকালে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।
ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো ৭২ বছর পার হতে চললেও এখনো সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে না। এমনকি সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত আইনটি ৩৭ বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আইনটির বাস্তবায়ন নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া একটি রুল ঝুলে আছে।
১৯৮৭ সালে সংসদে পাস হয় বাংলা ভাষা আইন। ওই বছরের ৮ মার্চ প্রণয়ন করা হয় ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’। এতে বলা হয়, এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। এই আইনে আরো বলা হয়, কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে সেটি বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি এই আইন অমান্য করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুলসহ আদেশ দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী ওই আদেশে বলা হয়, নামফলক, অফিস-আদালত সর্বত্রই বাংলার ব্যবহার করতে হবে। টেলিভিশন ও পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে বাংলায়। পাবলিক প্লেসে বাংলায় লিখতে হবে। ১৯৮৭’র আইন অনুযায়ী কেন সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে না সে বিষয়ে একটি রুলও জারি করা হয়। কিন্তু সে রুলটির শুনানি এখনো হয়নি।
২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিচারকাজে ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রয়োগ বিষয়ে একটি সুপারিশ পেশ করে আইন কমিশন। একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই দুটি ঘোষণাপত্র জারি এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইন কমিশন সুপারিশে উল্লেখ করে।
এদিকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানরা পৃথক বাণী দিয়েছেন। একুশের প্রথম প্রহরে রাত ১২টা এক মিনিটে শহীদ বেদিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর থেকেই শোক ও শ্রদ্ধার প্রতীক সাদা-কালো পোশাকে, খালি পায়ে, শিশিরসিক্ত পথ মাড়িয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা সমবেত হতে শুরু করেন শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। ঢাকাসহ সারা দেশের স্কুল-কলেজে, জেলা ও থানা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে সর্বস্তরের জনগণ। এদিকে পাড়ায়-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের নিজ হাতে গড়া শহীদ মিনারও আজ সেজে উঠেছে ভবিষ্যৎ প্রজšে§র কাছ থেকে পাওয়া ফুলেল শ্রদ্ধায়।
সেদিন যা ঘটেছিল :
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এই মন্তব্যটুকুই ভাষা আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এর প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। আর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সরকার। এতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য পিছিয়ে গেলেও ছাত্রদের দৃঢ়তায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না-জানা অনেকে নিহত হন। এরপর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলন। পিছু হটতে বাধ্য হয় নাজিমুদ্দীন সরকার। মায়ের ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাংলাদেশের, বাঙালির চির প্রেরণার প্রতীক। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাঙালি জাতির এক অনন্যসাধারণ অর্জন।
২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ছুটির দিন। এ দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এ উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সব উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
© দিন পরিবর্তন