logo

সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:19 Feb 2024, 02:12 AM

সিন্ডিকেট ভাঙতে কঠোর সরকার


বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে আসছে পরিবর্তন

চক্রাকারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে। সিন্ডিকেটের কারণে চাল, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের বাজারে অস্থিতিশীলতা এখনো অব্যাহত। সব মিলিয়ে দেশে খাদ্যপণ্যে স্মরণকালের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দৃশ্যমান। ফলে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এবার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে কাজ করবে সরকারের বিশেষ টাস্কফোর্স।

আর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে শুরু হচ্ছে মাহে রমজান। মাস শুরু হতে আর মাত্র ২২ দিন বাকি। তাই এ মাস থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে লাগাম টানতে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি বাজারকে সিন্ডিকেটের কবল থেকেও মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় বেশ কিছু পণ্যের দাম বেধে দেওয়ার মাধ্যমে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম বন্ধ করতে যাচ্ছে। এ কারণে আগামী মঙ্গলবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সভা ডাকা হয়েছে। এরপরই অত্যাবশ্যকীয় নিত্য পণ্যের দাম বেধে দেওয়াসহ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এবার বাজার নজরদারি ব্যবস্থাপনায় একযোগে কাজ করবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, মূল সংকটের সমাধান না করে এলোমেলোভাবে তদারকি করলে সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বরং কোনো কোনো পণ্যের বাজার উল্টো তেতে উঠতে পারে। তাই বাজারের লাগাম টেনে ধরতে হলে সবার আগে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। একই সঙ্গে অবৈধ মজুতদারদের কঠোর সাজার আওতায় আনা জরুরি। আর এসব কার্যক্রম সারাবছর তদারকি করতে হবে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু জানান, রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ ও দাম নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এ বিভ্রান্তি দূর করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আমরা মাসখানেক ধরে এ চেষ্টা করছি, রমজান শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই সেটার বাস্তবায়ন হবে। আমাদের জাতীয় যে কমিটি আছে, জাতীয় টাস্কফোর্স মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বৈঠকে বসবো। সেখানে তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ইন্ডিকেটিভ (নির্দেশক) মূল্য পুনর্নিধারণ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, আমি আগেও বলেছি, সবকিছু রমজানকে কেন্দ্র করে। রমজান শুরু হবে ১১ মার্চ। যে তারিখে কারখানা থেকে তেল বের হবে, সেই তেলের বোতলে নতুন মূল্য মার্ক করা থাকবে। প্রথমে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়, পরে সেটা পুনর্নিধারিত ট্যারিফ অনুসারে খালাস হওয়ার পর কারখানায় গেলে সেই উৎপাদিত তেলেরই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ের মনিটরিং থাকবে। যেদিন থেকে ঘোষণা করা হবে, সেদিন থেকে আমাদের কারখানা মূল্য, টিপি ও ভোক্তা পর্যায়ের মূল্য একদিনে পরিবর্তন হবে। আমরা যেদিন নির্ধারণ করবো, সেদিন এমআরপি নির্ধারণ করে দেব। সেটা হচ্ছে, এমআরপি সর্বোচ্চ এত টাকায় বিক্রি হবে, এর বেশিতে কেউ বাজারে বিক্রি করতে পারবে না।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্তেহারে মূল প্রত্যাশা ছিল দ্রব্যমূল্য সহনশীল রেখে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া। ব্যবসায়ীদের সব সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকার ইতোমধ্যেই দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর যাতে কোনো মহল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে জনদুর্ভোগ বাড়তে না পারে সে ব্যাপারে কাজ করছি।

কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ বলেছেন, বাজারে সিন্ডিকেট বলে কিছু থাকবে না। সিন্ডিকেট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। হাটবাজারে যারা মজুতদারি করে, তাদের অনুরোধ করব, তারা যেন হারাম ব্যবসা না করে। সিন্ডিকেট কীভাবে ধ্বংস করা যায়, তার জন্য প্রক্রিয়া কী, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজার তার নিজস্ব গতিতে চলে। এটি পণ্য সরবরাহ, চাহিদা ও প্রত্যাশা এ তিনটির ওপর পরিচালিত হয়। সরকার চাইলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বাংলাদেশে তেল, চিনি ও ডিমসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের জন্য রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি। স্বাভাবিকভাবেই ওই কোম্পানিগুলোর ব্যবসা একচেটিয়া হয়ে উঠেছে। পাড়ার ছোট দোকান বা বাজারের বিক্রেতাদের ওপর নজরদারি না করে সরকারের উচিত বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর ওপর নজরদারি করা।

ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক সপ্তাহে অস্বাভাবিক বেড়েছে রমজানের অন্যতম ভোগ্যপণ্য ছোলার দাম। এক সপ্তাহ আগে পাইকারিতে ভালো মানের প্রতিকেজি ছোলা (অস্ট্রেলিয়া) বিক্রি হয়েছে ৮৭ টাকা। দাম ১০ টাকা বেড়ে সপ্তাহ শেষে একই ছোলা ৯৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের যেসব ছোলা ৮০ টাকায় বিক্রি হতো, তার দাম এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ টাকায়। একইভাবে স্বাভাবিক সময়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হওয়া সাদা মটরের দাম ঠেকেছে এখন ৬৬ টাকায়।

পাইকারি পর্য়ায়ে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৪ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ১৩২ টাকায় বিক্রি হতো। এছাড়া গত সপ্তাহে পাইকারিতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬১ টাকা, পাম তেল ১৩১ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৩৪ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন সয়াবিন তেল ১৫৫ টাকা, পাম তেল ১৩৪ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৩৭ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী বলেন, খোলা চিনি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫ টাকা কেজি, ছোলা ১১০ টাকা কেজি, বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা লিটার বিক্রি করছেন তারা।

মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বশির উদ্দিন বলেন, শুল্কছাড়ের প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় লাগার কথা। আর যে হারে শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছে, তাতে বাজারে প্রভাব পড়বে বলেও মনে হয় না। বাজারে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাড় দিলে, বড় ছাড় দিতে হবে এবং পদক্ষেপ নিতে হবে সঠিক সময়ে। এমন সময়ে সিদ্ধান্ত এল, যখন রোজার পাইকারি বেচাকেনা অনেকটা হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তে গড়িমসি হলে বাজারে দাম না কমে, বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক করছাড় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেলে কেজিতে সাত থেকে আট টাকা শুল্ক-কর কমবে। চাল আমদানিতে প্রতি কেজিতে শুল্ক কমবে সাড়ে ২৩ টাকা। এ ছাড়া কার্টনে আনা সাধারণ মানের খেজুরের কেজিতে শুল্ক কমবে ৩৩ টাকা। সবচেয়ে কম, মানে কেজিতে ৭৫ পয়সা শুল্ক কমবে চিনিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল রয়েছে। এই সেল পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তাদের কাজ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ে সচিবের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো। এ ছাড়া কোনো কাজই করছে না। সেল থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রতিবেদন দেওয়া হয় সচিবের কাছে। তবে সচিব ছাড়া অন্য কেউ জানতে পারেন না প্রতিবেদনে কী থাকে। দেশে নিত্যপণ্যের চাহিদা বছরে কত, কী পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে, কী পরিমাণ মজুত আছে, ঋণপত্র পরিস্থিতি ও তা নিষ্পত্তিসংক্রান্ত কোনো তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। ফলে কখনো অতিরিক্ত পণ্য আমদানি হচ্ছে। আবার কখনো সংকট তৈরি হচ্ছে।

বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (ডিপিডির) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রথমত, টাকার অবনমনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমলেও দেশে তা কমছে না। দ্বিতীয়ত, বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা নেই। এক্ষেত্রে ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য বা প্রতিযোগিতা কমিশনের আরও সক্রিয় ভূমিকা দরকার। তৃতীয়ত, চাহিদা, উৎপাদন ও প্রয়োজন কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এতে কখন কী পরিমাণ পণ্য ছাড়তে হবে তার হিসাব পাওয়া যায় না। অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও চাহিদা কত, উৎপাদন কত ও কখন কতটুকু বাজারে ছাড়া হবে তার সঠিক তথ্য নেই। কখন কতটুকু আমদানি করতে হবে, সেসবের সমন্বয় নেই। এখানে অনেক দুর্বলতা আছে। ফলে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না, সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দু-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ল, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকল। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়া কঠিন হতো।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সমস্যার মূলে যেতে হবে। বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এভাবে চিন্তা করা গেলে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। যদি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মজুতদার বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কেননা তারা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থেকেই অপরাধ করে। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে প্রশাসন কিছু করতে পারবে না।

/মামুন



© দিন পরিবর্তন