logo

সিস্টেম লসে সংকটে বিদ্যুৎ খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:21 Jul 2022, 06:21 PM

সিস্টেম লসে সংকটে বিদ্যুৎ খাত


ক্রমাগত সফলতার প্রচার চালিয়ে অবশেষে বড় সংকটে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বস্তরে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি, সংস্থাটি থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ভুল তথ্য প্রদান, ভৌতিক সিস্টেম লস আর ভর্তুকির ভারে ন্যুব্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।  সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে এখন অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের সম্মুখীন দেশ।  অথচ গত এক যুগে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচগুণ।  কিন্তু উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে স্বনির্ভর জ্বালানিমুখী করে তৈরি করা হয়নি।  ফলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে আমদানিনির্ভর জ্বালানি এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বিদ্যুৎ খাতেও সিস্টেম লসের কারণে অপচয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।  মাত্র এক শতাংশ সিস্টেম লস হলেই অন্তত ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি গুনতে হয় বিদ্যুৎ খাতে।  সিস্টেম লসের নামে সংস্থাটিতে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা লুটপাট করে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন।  আর এই সিস্টেম লসের দায় চাপে গ্রাহকের ওপর।  তারপরও শেষরক্ষা হয়নি বিদ্যুৎ খাতে।

গত ২১ মার্চ দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসার ঘোষণা দেয় সরকার।  এতে সবার ঘরে বিদ্যুৎ দিতে সংযোগ সহজ হয়েছে।  এরপরও বিদ্যুতের অপব্যবহার ও চুরি বন্ধ হয়নি।  সিস্টেম লস প্রতি বছর কিছু করে কমছে।  কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত জায়গায় আসেনি।

বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অন্যতম সঞ্চালক ব্যবস্থা।  বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় এখনো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে।  ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) কর্তৃক সর্বশেষ প্রকাশিত ‘এনার্জি আর্কিটেকচার পারফরম্যান্স ইনডেক্স’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে বিদ্যুতের কাঠামোগত দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৪তম।

এদিকে উচ্চ মূল্যের তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করায় এ খাতেও লোকসানের বোঝা ভারী হয়েছে।  পাশাপাশি বেড়ে গেছে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা।  সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করে দিয়েছে।  এতে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।  পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও আশু করণীয় নির্ধারণে গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের।  এতে গত মঙ্গলবার থেকে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং ছাড়াও সপ্তাহে এক দিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখাসহ একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়।  পাশাপাশি তেলের ব্যবহার কমাতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

পিডিবির তথ্যমতে, ১৮ জুলাই পর্যন্ত ডিজেলচালিত সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু ছিল।  এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ছয়টি ও একটি সরকারি।  বেসরকারি ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট।  আর সরকারি কেন্দ্রটির সক্ষমতা ২২৫ মেগাওয়াট।  ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে গেছে এক হাজার ২২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র।  ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়ায় দেশজুড়ে চলছে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং।

অন্যদিকে, বর্তমানে কয়লায় ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাসে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলে ২৮ শতাংশ ও ডিজেলে ছয় শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।  তবে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে গড় উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি।  এসব কেন্দ্রে শুধু জ্বালানি ব্যয়ই পড়ে ১৮-২০ টাকা। যদিও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলে শুধু বন্ধ হবে জ্বালানি তেল সাশ্রয়, তবে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সরকার।
পিডিবি জানায়, বেসরকারি খাতের ছয়টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে প্রায় এক হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়।  এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখলেও ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই পরিশোধ করতে হবে।  এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়বে অনেক বেশি।

এদিকে জ্বালানি তেলে দাম বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ খাতে ক্রমাগত ভর্তুকি বেড়েই চলেছে।  ২০২০-২১ অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।  তবে ২০২১-২২ অর্থবছর জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসেই ভর্তুকি দেয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা।  এরপর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ রাখে সরকার।  এতে সংকটে পড়ে পিডিবি।  নগদ তহবিল সংকটে গত মার্চ থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি।  এতে দেড় বিলিয়ন ডলার (১৪ হাজার কোটি টাকা) বিল বকেয়া পড়ে গেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোয়। সব মিলিয়ে বড় সংকটে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত।

অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল দ্রুত পরিশোধের দাবি জানিয়ে সমপ্রতি পিডিবিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা)।  সংগঠনটি জানায়, ৬০ শতাংশ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফেব্রুয়ারির বিল পেয়েছে।  আর মার্চ থেকে কোনো কেন্দ্রই বিল পায়নি।  তবে সে সময় ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা।  এখন তা বেড়ে প্রায় ৯৪ টাকা হয়ে গেছে।  এ নিয়ে জটিলতা বাড়ছে।

যদিও বিদ্যুৎ খাতের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র।  পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য মাসে প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে, এক বছর আগেও যা ছিল এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।  অর্থাৎ এক বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়েছে ২০ শতাংশ।  ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে ১৯ তারিখ জাতীয় সংসদ ভবনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জরুরি বৈঠকও করে।

পিডিবির হিসাবমতে, বিদায়ী অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।  আর এ বোঝা বইতে গিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছাড়িয়ে যাবে ২০ হাজার কোটি টাকা।  তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।  অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।

এদিকে বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি খাতেও সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।  বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেলের মজুত ক্রমেই কমে যাচ্ছে।  বর্তমানে জ্বালানি তেলের মজুত কমে ৪০ দিনের নিচে নেমে গেছে।  সাধারণত বিপিসি ৪০-৪৫ দিনের মজুত রাখে।  তবে সংকট কাটাতে সহজ কোনো পথ পাচ্ছে না বিপিসি।  জ্বালানি আমদানি করতে গিয়েও বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি। ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারছে না বিপিসি।  এতে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।  সারাদেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে।  বাকি ৯০ শতাংশ পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে।

২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ খাতে সামগ্রিকভাবে বছরে গড় সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ।  গত অর্থবছরে (২০২০-২১) এটি কমে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।  এর মধ্যে সঞ্চালন লাইনে ক্ষতি হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।  আগের বছরের চেয়ে এটি বেড়েছে।  দেশের একমাত্র সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি (পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ) বলছে, সঞ্চালন লাইন প্রতিবছর বাড়ছে।  এতে বিদ্যুৎপ্রবাহে কারিগরি ক্ষতি বাড়াটাই স্বাভাবিক।

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, আরও এক হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন বাড়বে।  এতে সিস্টেম লস বাড়ার কথা।  এ বছর তা ৩ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।  আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অপচয় কমানো হচ্ছে। ভারতের চেয়ে এটি এখনো কম আছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গত মঙ্গলবার থেকে লোডশেডিং শুরু করেছি।  এভাবে এক সপ্তাহ দেখব।  যদি দেখি এক ঘণ্টায় হচ্ছে, তাহলে ভালো।  চেষ্টা করব পিক ও অফ পিকের জায়গাটা দেখার জন্য।  আমরা যদি দেখি পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার করতে পারব, ফাইন।  আর যদি দেখি, অফ পিকের জায়গায় এক ঘণ্টা দিলে কভার হচ্ছে, তাহলে সেটাই করব।

তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে সারা বছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দিই, সেই মূল্য তো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না।  ডিজেল থেকে যে বিদ্যুৎ হয়, তা ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মতো পড়ে প্রতি ইউনিট।  আর বিদ্যুৎ বিক্রি করছি গড়ে প্রায় সাত টাকায়।  ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে।



© দিন পরিবর্তন