নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:13 Jul 2022, 05:41 PM
সুগন্ধি ধান কাটারিভোগ এখন জিআই পণ্য
আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার সিংগভাগ ধান এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হয়। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে চাল আমদানি করতে হয় না। যদিও গত দুই বছর ধরে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যার কারণে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় ধান-চালের বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী ছিল। আবার সরকার আপৎকালীন খাদ্য মজুত গড়ে তুলতে প্রতি বছরই বোরো ও আমন সংগ্রহ মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে ধান-চাল সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু গত দুই বছরে ধান-চালের দাম বেশি থাকায় অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহও শতভাগ সফল হয়নি। ফলে সরকারি খাদ্য মজুত কমে আসে। বাধ্য হয়ে সরকার দুই দফায় শুল্ক কমিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এ বছর সরকার অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ সফল করতে পারবে।
উল্লেখ্য, দেশের মানুষের সক্ষমতা যেমন বেড়েছে, তেমনি রুচি বোধেরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন নিম্ন আয়ের মানুষও আর সহসাই মোটা চালের ভাত খেতে চান না। কম-বেশি সবাই চিকন সরু চাল খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে দেশের চিকন চালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শুধু চিকন চালই নয়, চিকন ও সুগন্ধি চালের চাহিদা দেশে-বিদেশে অনেক বেড়েছে। এখন এসব চিকন চাল ছোট ছোট প্যাকেটজাত করে বিপণন করছে দেশের অনেক নামি-দামি করপোরেট গ্রুপ। এমন এক সময় ছিল, যখন হাসকিং মিলে চাল প্রস্তুত হতো, সে চাল দিয়ে মানুষের মুখের আহারের জোগান হতো। এখন কিন্তু সেদিনের বিদায় হয়েছে। এখন দেশের হাজার হাজার হাসকিং মিল চাতাল প্রায় বন্ধের মুখে। এখন স্থাপিত হয়েছে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় চালকল। এসব চালকলের সঙ্গে যুক্ত এখন দেশের অনেক শিল্প গ্রুপ। অর্থাৎ একচেটিয়া পুঁজির যখন আধিপত্য সৃষ্টি হয়, তখন আর মাঝারি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাতে ব্যবসা থাকে না। তখন তারা দেশের সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। যারা ওষুধ প্রস্তুত করতো একসময়, তারা এখন চাল, তেল, ডাল, সোয়াবিন থেকে শুরু করে পরিবহন সেক্টর পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। এমনকি দেশের এখন শিক্ষার যে বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, সেখানেও তারাই বিনিয়োগ করছে। প্রতিষ্ঠা করেছে মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে দেশের ছেলেমেয়েরা বাড়তি খরচে লেখাপড়া করতে বাধ্য হচ্ছে। এটা একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর দেশের চরিত্র। কারণ এখানে সরকারি মদতে তারা অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে। সে অর্থ আবার দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করে। অর্থাৎ বিনিয়োগের চেয়ে অর্থ পাচারই তাদের কাছে অনেক বেশি নিরাপদ।
ফলে উপযুক্ত বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। দিন দিন বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যে কারণে শিক্ষিত বেকারেরা এখন কৃষি চাষাবাদের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে। নতুন নতুন উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ধান তারা আবাদ করছে। আর এসব ধান কিনে নিচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় চালকলগুলো। যারা সেখানে উন্নতমানের চাল তৈরি করে, ছোট-বড় আকারে প্যাকেটজাত করে বিপণন করছে। ফলে দেশের চিকন চালের চাহিদা কয়েক বছরে কয়েকগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আর অর্থনীতির সূত্রই হচ্ছে, যে পণ্যের চাহিদা বাড়বে, সে পণ্যের দামও বাড়বে। আর যে পণ্যের দাম বাড়বে, সে পণ্যের উৎপাদনও বাড়বে। ফলে এখন চালের রাজ্য খ্যাত দিনাজপুর অঞ্চলে সুগন্ধি কাটারিভোগ ধানের চাষাবাদ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ সুগন্ধি এ ধানের বাজার মূল্য বেশি। ফলে এই ধান আবাদ করে ধানচাষিরা লাভবানও হচ্ছেন। এরই মধ্যে দিনাজপুরের কাটারিভোগ ধান ভৌগোলিক নির্দেশকে (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। অর্থাৎ কাটারিভোগ এখন বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। গত ১৭ জুন শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) কাটারিভোগের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে জিআই সনদ হস্তান্তর করে। এ বিষয়ে ডিপিডিটির রেজিস্ট্রার অতিরিক্ত সচিব আব্দুস সাত্তার বলেন, এখন থেকে অন্য কোনো দেশ কাটারিভোগকে তাদের নিজেদের পণ্য বলে দাবি করতে পারবে না। সুবিধা হচ্ছে, এই পণ্য অন্য কোনো দেশকে চাষাবাদ বা সম্প্রসারণের জন্য রয়্যালটি দিতে হবে। পাশাপাশি এ স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে এখন চিকন চালের চাহিদা ও রপ্তানি বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, শুধু জিআই স্বীকৃতির কারণে কাটারিভোগের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, (সূত্র বাংলাদেশের খবর, তাং- ২৭/০৬/২০২১)।
উল্লেখ্য, শুধু দিনাজপুর জেলাতেই নয়, বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে এখন সুগন্ধি জাতের ধানের চাষাবাদ হচ্ছে। জাতগুলোর মধ্যে চিনিগুঁড়া, কালিজিরা, কাটারিভোগ অন্যতম। প্রধানত আমন মৌসুমে (খরিপ-২) সুগন্ধি ধানের চাষ হয়ে থাকে। অর্থাৎ আমন মৌসুমে উৎপাদিত ধানের প্রায় ১০ শতাংশ সুগন্ধি জাতের ধানের আবাদ হয়। কিন্তু কাটারিভোগ জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় দামও যেমন বাড়বে, তেমনি এখন উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, দেশে প্রতিনিয়তই জনসংখ্যা বাড়ছে। আর জনসংখ্যা বাড়া মানে খাদ্য চাহিদা বাড়া। যদি মাত্রাতিরিক্ত চিকন সুগন্ধি চালের আবাদ বেড়ে যায়, তাহলে অন্যান্য সাধারণ জাতের আবাদ কমে আসবে। তখন কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেকাংশেই কঠিন হবে। এসব কারণে দেশে মোটা জাতীয় ধানের চাষাবাদও দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর সরকার যেহেতু মোটা চাল সংগ্রহ করে থাকে, সেহেতু মোটা ধানের আবাদও বেশি পরিমাণ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারকেও নীতি কৌশল পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণভাবে ধান, চাল সংগ্রহ করতে হবে। সরকার অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের জন্য চালের একটা দর নির্ধারণ করে থাকেন। যেহেতু মোটা ধানে চালের রেশিও বেশি, সেহেতু চালকল মালিকরা মোটা ধান থেকে চাল প্রস্তুত করে চুক্তিকৃত চাল খাদ্যগুদামে জমা করেন। এক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি চিকন ও মোটা দুই ধরনের চালের দুই প্রকারের দর নির্ধারণ করে চাল-ধান সংগ্রহ করে, তাহলে চিকন চালও সরকারের খাদ্যগুদামে মজুত হবে। এতে সুবিধা হবে, চিকন চাল সরকার প্রতি কেজিতে ৩/৪ টাকা বেশি দামে কিনলে চিকন ধানের আবাদও বেড়ে যাবে। কারণ সাধারণ মানুষ এখন চিকন চালের ভাতই খেতে পছন্দ করেন। অর্থাৎ মানুষের রুচিবোধ, চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের দিকেই সরকারকে নজর দিতে হবে। স্রোতের বিপক্ষে তো আর চলা যাবে না, হয়তো চলা যাবে সত্য কিন্তু প্রকৃত অর্থে যথাযথ সুফল মিলবে না।
আবার প্রায় ১ কোটির মতো বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করেন। যারা চিকন চাল খেতে অভ্যস্ত। ফলে প্রতি বছরই চিকন সুগন্ধি চালের রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৩৬টি দেশে প্যাকেটজাত সুগন্ধি চাল রপ্তানি করছে। এর মধ্যে এসিআই, প্রাণ, ইস্পাহানি, স্কয়ার অন্যতম। বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশেও তারা সুগন্ধি চিকন চাল প্রক্রিয়াকরণ করে বিপণন করছে। এ খাতে তারা বিনিয়োগ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি করছে। এখন পাকিস্তান ও ভারত সুগন্ধি চাল রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী দেশ। সুগন্ধি চিকন চালের রপ্তানি বৃদ্ধি ও দেশীয়ভাবে ভোগ বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই সরকারকে গবেষণা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে উচ্চ ফলনশীল জাতের সুগন্ধি চিকন চালের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। যেন বোরো মৌসুমেও এ-জাতীয় সুগন্ধি চিকন চালের চাষাবাদ করা সম্ভব হয়। কারণ শুধু আমন মৌসুমে সুগন্ধি চিকন ধানের আবাদ করে দেশি-বিদেশি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
যেহেতু আমাদের ভৌগোলিক সীমারেখা কার্যত স্থির, অথচ মানুষ বাড়ছে। ফলে নানা জাতের উন্নত চালের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একমাত্র ভরসা এখন অধিক গবেষণা। কারণ গবেষণা করে উন্নত প্রযুক্তিতে ভালো মানের উচ্চফলনশীল জাতের চিকন ধান উদ্ভাবন করা এখন সময়ের দাবি। অবশ্য আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন যেমন বেড়েছে তেমনি ধানের ফলনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এসেছে। আমরা আশাবাদী, আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে নিকট ভবিষ্যতে আরো সুগন্ধি চিকন ধানের জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হবেন এবং মানুষের চাহিদা পূরণে বড়মাপের অবদান রাখবেন। এজন্য সরকারকে প্রয়োজনমতো ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
লেখক : কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিশ্লেষক
© দিন পরিবর্তন