logo

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

Published:07 Feb 2024, 03:39 PM

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা নেই


স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্য সূচকগুলোর উন্নতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে, কিন্তু জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাস্তব চিত্রটি বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারপরও স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যার ফলে করোনা মহামারি পরে শুধু ডেঙ্গুতেই ২০২৩ সালে মারা গেছেন এক হাজার ৭০৫ জন। অপ্রতুল বরাদ্দ আর অনিয়ম-দুর্নীতি কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি আছে বলে আখ্যাও দিয়েছে হাইকোর্ট। অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা নেই বলে মানুষ বিদেশ যাচ্ছে বলে বলেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনও।

প্রতি ১০ বছর পর আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডি ‘বাংলাদেশে রোগের বোঝা এবং ঝুঁকির কারণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের ওই স্ট্যাডিতে স্বাস্থ্যসেবায় বৈশ্বিক মানদণ্ডের আশপাশেও নেই বাংলাদেশ। সংস্থাটির সর্ব শেষ গবেষণা প্রতিদনে (১৯৯০-২০১৯) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থ্যয় দুর্বলতা রয়েছেই, তার মধ্যে মানুষের প্রকৃত রোগ নির্ণয় পদ্ধতিও খুব দুর্বল।

সংস্থাটি ১৯৯০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে রোগের বোঝা এবং ঝুঁকির কারণগুলো অনুমান করতে গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ, ইনজুরি এবং রিস্ক ফ্যাক্টরস স্টাডি (এইউ) ২০১৯ থেকে ডেটা ব্যবহার করেছে। ওই পদ্ধতিগত বিশ্লেষণের জন্য, তারা জšে§র সময় আয়ু, মৃত্যুর হার, জীবন হারানোর বছরগুলো, অক্ষমতাসহ জীবনযাপন এবং অক্ষমতা-এর অনুমান করার জন্য মাল্টিস্টেজ মডেলিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে অত্যাবশ্যক নিবন্ধন ব্যবস্থা, জরিপ এবং আদমশুমারি থেকে ডেটা বিশ্লেষণ করেছি। সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন-বছর। জিবিডি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যের অবস্থার তুলনা করে। এতে ভুটান, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানের নামও রয়েছে।
এদিকে দেশে এখন পর্যন্ত ২০ লাখ ৪৭ হাজার ১০৮ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২০ লাখ ১৪ হাজার ৪০৮ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৯ হাজার ৪৮২ জন মারা গেছেন। করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতে দেশে ডেঙ্গুতে গত বছরে ১৭০৫ জনের প্রাণ গেল। দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক বছরে মৃত্যুর রেকর্ড এটি। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮৫৩ জন।

প্রাথমিক কিছু পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়। দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের ১০ থেকে ১৫ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এছাড়া শূন্য দশমিক ৮৮ জন নার্স এবং শূন্য দশমিক ৬০ জন মেডিকেল টেকনিশিয়ান।

অতিসম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ওষুধ ও সরঞ্জামাদি সংক্রান্ত সরকারি ক্রয়ের টেন্ডারে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রকাশ্য লুটপাটের ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। শেরপুর জেলার নকলা, নালিতাবাড়ি ও ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওষুধ ও সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত টেন্ডারে অংশগ্রহণে আগ্রহী ঠিকাদারদের টেন্ডারের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। শুধুই এক ব্যক্তির মালিকানাধীন তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দরপত্র ছাড়া আর কোনো দরপত্র গ্রহণ করেনি টেন্ডার কমিটি। ভুক্তভোগী ঠিকাদাররা জানিয়েছেন, পে-অর্ডার যুক্ত দরপত্রগুলো নিয়ে নির্দ্দিষ্ট দিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় ঢুকতে পর্যন্ত পারেননি তারা। সেখানে ওই তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ভাড়াটে অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীরা অন্য সব ঠিকাদারের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। যারা দরপত্র জমা দিতে চেষ্টা করেন অস্ত্রের মুখে তাদের কাছ থেকে দরপত্র ও পে-অর্ডারগুলো ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ঠিকাদারের দরপত্র ও পে-অর্ডার ছিনতাই করে নেয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিত অভিযোগ করা হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নকলা থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করা হয়েছে।

এদিকে স্বাস্থ্য খাতে শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দুর্নীতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে চিকিৎসকরা মুনাফা করছেন। সবকিছুরই একটা সীমা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব সময় কেনাকাটার জন্য প্রস্তুত। একমাত্র আল্লাহই জানেন ওই কেনাকাটায় কী থাকে। আপনারা ১৭ কোটি মানুষের টাকা খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং কারা মহাপরিদর্শকের আইনজীবীদের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, আপনারা কতজনের কাছে ক্ষমা চাইবেন? আপনারা যদি পরকালে বিশ্বাস করতেন তবে চুরি করতে পারতেন না।

এ সময় বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, এ দেশের সন্তান হিসেবে আমরা অনেক কিছুই জানি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। যা দেখেছি তা বিদেশের একটি ছোট হাসপাতালের চেয়েও খারাপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকার কাছাকাছি হলেও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে। অধিকাংশ সরকারি চিকিৎসক ঢাকায় বসে বেসরকারিভাবে রোগী দেখার কারণে গ্রামীণ এলাকার মানুষকে যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে এ ধরনের দুর্নীতি হতে পারত না।

বিএসএমএমইউ ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবায় এখানো পুরনো ধারা রয়েছে। স্বাস্থ্যরক্ষায় এখন পর্যন্ত আমাদের ধারণা ওষুধকেন্দ্রিক। স্বাস্থ্যে মানুষের যে ব্যয়, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ওষুধ খাতে করেন। মানুষের গরিব হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় প্রধানত একটি কারণ অসংক্রামক (এনসিডি) রোগের ওষুধের বোঝা।

একটা পরিবারে বয়স্ক মানুষ থাকা এবং সারা বছর তার ওষুধের ব্যয়ের ফলে পরিবারগুলো দরিদ্রসীমার নিচে চলে যায় ও দরিদ্র হয়ে ওঠে। সুতরাং যদি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হয়, তাহলে প্রধান কাজ হবে ওষুধের ভার মানুষের কাঁধ থেকে রাষ্ট্রকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এটি সরানোর একটা সহজতম উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আবশ্যকীয় ওষুধগুলোর একটা তালিকা করা। এর সংখ্যা ২৫০-২৮০-এর মতো হতে পারে৷ বর্তমানে বিজ্ঞানের যতটুকু বিকাশ হয়েছে, সে অনুযায়ী আনুমানিক ২৫০-২৮০টি ওষুধের মাধ্যমে বিভিন্ন গাইডলাইন অনুসরণ করে বাংলাদেশের রোগের যে প্রাদুর্ভাব, তার প্রবণতা ৯৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।

আমাদের আনুমানিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে ওষুধের ব্যয়। এই ৩৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে রাষ্ট্রের ব্যয় মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকা। ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচের মধ্যে রাষ্ট্রের অবদান হচ্ছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। বাকি ৯২-৯৩ শতাংশ ওষুধ ব্যয় সেবাগ্রহীতাকেই নির্বাহ করতে হচ্ছে।

অসংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে মেডিসিন কর্নারগুলো একটি ভালো উদাহরণ তৈরি করেছে। প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ সেখান থেকে ডায়াবেটিসসহ তিনটি রোগের ওষুধগ্রহণ করছেন। বরাদ্দ বাড়ানো ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বাড়ানোর পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ দায়িত্ব সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রতিশ্রুতি দ্বিপক্ষীয় হতে হবে। যারা সেবা প্রদান করবেন, তাদের প্রতিশ্রুতি থাকবে, আর যারা সেবা গ্রহণ করবেন, তাদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না, এটি হতে পারে না। সেবাগ্রহীতারা তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য যেসব জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচন করবেন, তারা যেন নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করেন, সেই জায়গায় আমাদের নজর দিতে হবে।


২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার আইন (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন) পাস হয়, যা ২০১০ সালে সংশোধন করা হয়। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে। বাংলাদেশে ৩২৯টি পৌরসভা ও ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা তাদের নেই। আমরা দক্ষতা না তৈরি করেই তাদের দায়িত্ব দিয়েছি। তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু তাদের সহায়তা দেবে কে!


সাপ্লাই সাইড নিয়ে চিন্তা করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি বিষয় (স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য মানবসম্পদ, স্বাস্থ্যতথ্য ব্যবস্থা, চিকিৎসাদ্রব্য, টিকা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য অর্থায়ন এবং স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্ব) নিয়ে চিন্তা করব। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এ ছয়টি উপাদানের অবস্থা দেখতে হবে। এমডিজি-৩ অর্জনের জন্য আমাদের প্রতি হাজারে ৪ দশমিক ৪৫ জন সেবা প্রদানকারী প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাত লাখ সেবা প্রদানকারী প্রয়োজন। এর মধ্যে ৯০ হাজার চিকিৎসক, আড়াই লাখ নার্স, চার লাখের মতো প্যারামেডিক প্রয়োজন। আমাদের রিসোর্স অনেক কম, যা দিয়ে প্রত্যাশিত অর্জন নয়।


অন্যদিকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কম থাকায় অনেক মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, আস্থা নেই বলেই মানুষ চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ ভারত যাচ্ছে, ব্যাংকক যাচ্ছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে রাতারাতি কোনো কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব না। আস্থা নেই বলেই মানুষ চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ ভারত যাচ্ছে, ব্যাংকক যাচ্ছে। রংপুর থেকে মানুষ ঢাকায় আসছে, তার মানে আস্থাহীনতার অভাব। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর ফিরিয়ে আনতে হলে গ্রাস রুট লেভেলে কাজ করা, যেটি আমি শুরু করেছি মাত্র। আমাকে আরও সুযোগ দিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি। আমি পারবো না শতভাগ, তবে আমি চেষ্টা করবো।

 



© দিন পরিবর্তন