নিজস্ব প্রতিবেদক
Published:31 Aug 2022, 06:13 PM
৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেবে সরকার
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিরোধে অবশেষে কমপক্ষে ৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পণ্যগুলো হলো চাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রড। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এসব পণ্যের নির্ধারিত মূল্য।
গতকাল মঙ্গলবার বাজারে পণ্যের সরবরাহ, মজুত ও আমদানি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের যৌক্তিক দাম কী হওয়া উচিত তা ঠিক করা হবে। এরপর বাজারে এই ঘোষিত দাম মানা না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীর তিন বছরের জেলও হতে পারে।
করোনা-উত্তর নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে যখন মানুষ মুখ তুলে কেবল দাঁড়াতে শুরু করেছিল ঠিক সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও কঠিন চ্যলেঞ্জের মুখে পড়ে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। যৌক্তিক কারণের বাইরেও এই সুযোগে দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাড়াতে থাকে দাম। সরকার মনিটরিং করেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না এই সিন্ডিকেটকে।
গত কয়েক মৌসুম ধরে ভরা মৌসুমেও চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন বাড়ছে এর কোনো সঠিক উত্তর নেই সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছেও। আমদানি শুল্ক মওকুফ করে কিংবা আমদানি বাড়িয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না চালের বাজার। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত রোববার আমদানি শুল্ক মওকুফ করা হয়। পাশাপাশি রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ করা হয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। এর আগে গত ২৪ জুন চালের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন আরো ৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হলো। তবে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেও এর কোনো প্রভাব পড়েনি চালের বাজারে।
বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহ আলম বাবু বলেন, চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আরো আগে নেওয়া উচিৎ ছিল। কারণ ডলার ও ডিজেলের দাম বাড়ায় এখন আমদানিতেও খরচও বেশি। তিনি বলেন, আমদানি চাল বাজারে আসতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে।
এদিকে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে দেশেও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছিল। যা ২০৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম কমলেও দেশি আমদানিকারকরা দাম কমানোর ক্ষেত্রে নানা অজুহাতে গড়িমসি করছিলেন। অতপর প্রথম দফায় প্রতিলিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা এবং গত ১৭ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো ভোজ্যতেল আমদানিকারকদের সংগঠন প্রতিলিটারে ১৪ টাকা কমিয়ে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ১৯৯ টাকা থেকে কমিয়ে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করে। যা পরের দিন ১৮ জুলাই সোমবার থেকে কার্যকর করারও সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তের পরেও এর কোনো প্রভাব বাজারে পড়েনি। আগের বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছিল সয়াবিন তেল।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানেও মিলেনি সুফল। অথচ গত ২৩ আগস্ট মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পরদিন থেকেই বাজারের সরবরাহ বাড়তে থাকে। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৭ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১৯২ টাকায়।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র তথ্যমতে, গত রমজানের ঈদের পর ৫ মে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার পুনঃনির্ধারণ করেছিল। ওই সময়ে সয়াবিনের দাম লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর গত ৯ জুন মিল পর্যায়ে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিলগেটে ১৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৯৯ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের খোলা পাম অয়েলের (সুপার) দাম মিলগেটে ১৫৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৫৫ ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৫৮ টাকা করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ২০০ থেকে ৪৯০ ডলার। অথচ ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় বাড়িয়েছেন প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম।
আবার গত চার মাসে তিনবার রডের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। কিছুদিন আগেও যেখানে এক টন রডের দাম ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ হাজার টাকা। বাজারভেদে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায়। রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে যাওয়া এবং জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে রডের দাম বেড়েছে। তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে দফায় দফায় বাড়ছে রডের দাম। নানান অজুহাতে রডের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেছেন, দামবৃদ্ধির বিষয়টি সামাজিক সংক্রমণ হয়ে উঠেছে। কার আগে কে দাম বাড়াবে এ ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। রডের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো অযৌক্তিক।
প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও কাঁচামাল সংকট বলে রডের দাম বাড়ানো হলো। এরপর জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে রডের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হলো। এখন জ্বালানি তেল ও ডলার সংকটের কথা বলে আরেক দফায় বাড়ানো হলো। জ্বালানি তেলের সঙ্গে রডের কি সম্পর্ক আছে তা বুঝতে পারলাম না। দায়িত্বশীলদের নজরদারির অভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে নির্মাণকাজে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
এরকম পরিস্থিতিতে সরকার ৯টি পণ্য চিহ্নিত করে সেগুলোর দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। গতকাল মঙ্গলবার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এ সংক্রান্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানান, আন্তর্জাতিক বাজারদর ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ৯টি পণ্যের যথার্থ দাম কী হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করে দেবে সরকার।
টিপু মুনশি বলেন, এতদিন ট্যারিফ কমিশন শুধু ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে এই পণ্যগুলোর দাম অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না। বিষয়গুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ধারাবাহিকভাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাজারে স্থিতিশীলতা তৈরি করা যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এই বৈঠক করেছে।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন থেকে ভোজ্যতেল ও চিনির পাশাপাশি চাল, আটা, ময়দা, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রডের দামও নির্ধারণ করে দেবে সরকার। সার্বিক বিবেচনায় এই পণ্যগুলোর দাম কী হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের সব পর্যায়ের অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা করে যথাযথ দাম নির্ধারণ করবে ।
নির্ধারিত দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। সরকার নির্ধারিত এই দাম কোনো স্তরের ব্যবসায়ী পর্যায়ে লঙ্ঘিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জরিমানার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বর্তমানে মজুত, কারসাজি কিংবা কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে বাড়তি দাম রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনসহ মাঠপর্যায়ের দায়িত্বে থাকা সব সংস্থাকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, কোনো ব্যবসায়ী কোনো পণ্যে কারসাজি করলে কিংবা অযৌক্তিক দাম রাখলে, মামলা দিতে হবে। শুধু জরিমানা করেই যেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা শেষ করা না হয়।
ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার, এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলাম, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
© দিন পরিবর্তন