পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে ডলার। টাকার সাথে ক্রমেই বাড়ছে ব্যবধান। তারপরও চাহিদানুযায়ী মিলছে না ডলার। এই সংকট মোকাবিলায় বিদেশে আটকে থাকা ১০ বিলিয়ন ডলার দেশে আনতে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও ডলার সংকটে এই মুহূর্তে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গতকাল মঙ্গলবার খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১১২ টাকায়। রাজধানীর দিলকুশা, মতিঝিল, পল্টন এলাকায় মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলারের সরবরাহ কম থাকায় তারা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বিক্রি করতে পারছে না। খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ডলারের দর অনেক বেড়েছে। দুই মাস আগে ১৭ মে প্রথম খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়ায়। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ।
খোলাবাজারে টাকার বিপরীতে এক দিনের ব্যবধানে গতকাল প্রতি ডলার রেকর্ড ৬ থেকে ৮ টাকা বেড়ে ১১২ টাকায় উঠে। আগের দিন সোমবারও এই বাজার থেকে এক ডলার কিনতে খরচ হয়েছিল ১০৪ থেকে ১০৬ টাকা। এ দামেও আশানুরূপ ডলার মিলছে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও একদিনে ডলারের দর বেড়ে এ পর্যায়ে ওঠেনি। মতিঝিল যমুনা মানি এক্সচেঞ্জের স্বত্বাধিকারী আনিসুজ্জামান বলেন, বাজারে ডলারের তীব্র সংকট। মঙ্গলবার ১১২ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। অথচ এক দিন আগেও ১০৫ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে এত দাম বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে ডলারের দাম উন্মুক্ত করে দেয়ার পর দাম বাড়ছেই। আর চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার নেই। অনেকে ডলার কিনে ধরে রাখতে চাইছে। তাই ডলার কিনতে এলেও সবাইকে দেয়া সম্ভব হয়নি।
কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, খোলাবাজারে তীব্র সংকট রয়েছে ডলারের। ব্যাংকের মতো খোলাবাজারেও ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে, বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম।
রাজধানীর মতিঝিলের অর্নেট মানি এক্সচেঞ্জের মাসুম আহমেদ বলেন, আমরা গত সোমবার ১০৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রতি ডলার ১০৭ টাকায় বিক্রি করেছি। মঙ্গলবার সকালে কিছুটা কম থাকলেও দুপুরে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১১০ টাকা থেকে ১১২ টাকায়। ডলার সরবরাহ কম থাকায় দর বাড়ছে বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে কোনো ক্রেতা আসলে তাদের খোলাবাজার থেকে না কিনে ব্যাংক থেকে ডলার নেওয়ার পরামর্শ দেই। কারণ ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার দিতে পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুডউইল মানি এক্সচেঞ্জের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সোমবার প্রতি ডলার ১০৭ টাকা থেকে ১০৭.৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। মঙ্গলবার শুরু হয়েছে ১১০ টাকা দিয়ে। বেলা যত গড়ায় দামও তত বাড়ে। এমন উল্টাপাল্টা ডলারের বাজার কখনও দেখিনি।
পুরানা পল্টনের চকবাজার মানি এক্সচেঞ্জের আমিনুল এহসান বলেন, ডলারের উল্টাপাল্টা রেট চলেছে। আমাদের অনেক ব্যবসায়ীর কাছে চাহিদা অনুযায়ী ডলার নেই। সকাল থেকে ডলার ১১০ টাকা করে বিক্রি করলেও দুপুরে তা ১১২ টাকা অতিক্রম করেছে। ক্রেতা কিছু থাকলেও বাজারে ডলার বিক্রেতা নেই। আশা করেছিলাম হজ যাত্রীরা দেশে ফিরলে কিছু ডলার সরবরাহ হবে। কিন্তু অন্যান্য সময়ের তুলনায় এবার দেশে ফেরা হাজিদের কাছ থেকে ডলার আমাদের বাজারে আসেনি।
জানা গেছে, বর্তমানে দেড় বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বিদেশে আটকে আছে। যেটা এখনো আনা হয়নি। এছাড়া ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে থাকা দেশীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট) প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট প্রসিডস রিকনসিলিয়েশন হিসাবে আটকে আছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার দ্রুত আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলো যদি বিপুল অঙ্কের এ ডলার বিদেশ থেকে না নিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক আর ডলার সাপোর্ট দেবে না। কারণ এখন পর্যন্ত মার্কেট স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সাপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের আয়নার মতো। ব্যাংকগুলোকে ডলার দিয়ে রিজার্ভকে একেবারে তলানিতে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যেভাবে সহযোগিতা করবে ঠিক একইভাবে রপ্তানির টাকাও ফেরত আনতে হবে। নিয়মের মধ্যে থাকলে যেকোনো ধরনের ঝুঁকি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কোনো দায় নেবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের সংকট নিয়ে আবারও বৈঠক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বৈঠকটি কখন অনুষ্ঠিত হবে তা নির্ধারণ হয়নি।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। আর এর বিপরীতে বাজার থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো তুলে নেয়া হয়। অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের ২৫ দিনেই (১ থেকে ২৫ জুলাই) প্রায় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারে ডলার সংকট কাটছে না।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকও কমছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর গত ১২ জুলাই দুই বছর পর এই সূচক ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এরপর থেকে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই অবস্থান করছে। গত সোমবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়তে শুরু করে। এই তুলনায় বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। এতে তৈরি হয় ডলারের সংকট। আবার আমদানিতে চাহিদা বৃদ্ধি ও সংকটের সুযোগ নিচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক্সেঞ্জ হাউজগুলোও ডলার মজুত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া অনেকেই পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি করে ডলার কিনে মুনাফা লুটছে। ডলারের দাম আরও বাড়বে- এই আশায় অনেকেই ডলার কিনতে ঝুঁকছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম আরো বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা ছাড়াও বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া রপ্তানি আয় আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যদি গত দুই বছরের ডলারের বাজার বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা দেখবো-ওই সময় আমাদের আমদানি চাপ কম ছিল। এমনকি ওই সময় আমদানি হওয়া অনেক পেমেন্ট বকেয়া ছিল; যা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন, বছরে দেশের মোট আমদানি হচ্ছে প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আমাদের রফতানি থেকে আসে ৫০ বিলিয়ন। আমদানি-রফতানি আয়ের মধ্যে ব্যবধান ৩০ বিলিয়ন। এই ৩০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আসে ২০ থেকে ২১ বিলিয়ন। অর্থাৎ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি থাকে।
তিনি বলেন, এই বছরের ১০ ডলারের ঘাটতি মোকাবেলায় এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ থেকে আসে ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। বাকি ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন যে ঘাটতি থাকে তার জোগান দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, এই অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৭ বিলিয়ন ডলার বাজারে সরবরাহ করা হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ডলার ও টাকার বিনিময় হার স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নির্ধারণ করে দিতো। টাকাকে রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয় ১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ। আর ২০০৩ সালে এই বিনিময় হারকে করা হয় ফ্লোটিং বা ভাসমান। এরপর থেকে আর ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। তবে বিনিময় হার ভাসমান হলেও পুরোপুরি তা বাজারভিত্তিক থাকেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই এতে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রেখে আসছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং রেট’ নীতি অনুসরণ করে আসছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL