তরিকুল ইসলাম সুমন:
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণের স্মার্ট প্রযুক্তির প্রসার ঘটছে কৃষিতে। মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগবালাই চিহ্নিতকরণ, জমি তৈরি, বীজ বপন, সার প্রয়োগ, কীটনাশক স্প্রে, পোকামাকড় দমন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, আগাছা দমন, ফসল কাটা, মাড়াই, ঝাড়াইসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ফসলের জমিতে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল কীট ব্যবহারে প্রতি মুহূর্তেই কৃষকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ফসলের আপডেট। এক্ষেত্রে সরকারিভাবেও চালু হয়েছে নানান প্রযুক্তি, দেওয়া হচ্ছে এসএমএস, জানানো হচ্ছে আবহাওয়া বার্তা। কোনো কোনো সংস্থা আবার কৃষিকাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসমৃদ্ধ অ্যাপ এবং ড্রোন ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিপণ্যের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি সময় ও শ্রম কমাতে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। ফলে বিগত বছরগুলোতে ধান থেকে শুরু করে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দানাদার পণ্যেরই উৎপাদনই প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কৃষক ও কৃষিবিদদের অবদানের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম স্থানে রয়েছে আমাদের অবস্থান। বর্তমানে বিশ্বে দানাদার শস্য উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৪৩টি জাত, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ধান, পাট, গম, তেলবীজ, সবজি ও মসলাজাতীয় শস্যের ১৯টি উচ্চ ফলনশীল এবং উন্নত গুণসম্পন্ন ১১৪টি জাত, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২১০টির অধিক ফসলের ৭০০টি প্রযুক্তি, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ২১টি জাত, বিজেআরআই ৬৪টি জাত, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আখের ৪৮টি ও সুগারবিট তাল ও স্টিভিয়ার জাত উদ্ভাবন ও উš§ুক্ত করা হয়েছে। জিএমও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটি বেগুনের ৪টি জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং বিটি তুলার জাত উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশি ও তোষা পাটের জীবনরহস্য আবিষ্কারসহ পাঁচ শতাধিক ফসলের ক্ষতিকর ছত্রাকের জীবনরহস্য উম্মোচন করা হয়েছে। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের ৫৪টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও উপযুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন পৌঁছেছে এক অভাবনীয় উচ্চতায়।
কৃষিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেছেন, আমরা সবাই দেশের কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই, আজ আমাদের জিডিপির শতকরা ৮০ ভাগ এই কৃষি খাত থেকে আসে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন তোমার কাজই হচ্ছে দেশের কৃষকের উন্নয়ন করা এবং ফসল যাতে উৎপন্ন বেশি হয় সেজন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। তাহলেই কৃষকরা দেশের কৃষিতে তাদের অবদান রাখতে পারবে। আমাদের কৃষি উপকরণের কোনো অভাব নেই। আমাদের মনে রাখা উচিত এই কৃষির উন্নয়ন হলে দেশ ও মানুষের উন্নয়ন হবে।
কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, যত দিন আমি মন্ত্রী হিসেবে থাকব অবশ্যই আপনাদের কল্যাণে ও দেশের মানুষের উপকারে কাজ করে যাব। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সব কিছু করা হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া। এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে। এখানে অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন, আমরা তাদের কাজে লাগাতে চাই। সঠিকভাবে কীটনাশক ও সার ব্যবহারের বিষয়ে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, কৃষিতে আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে কৃষির উন্নয়নে একটি অন্তরায় হলো আমদানীকৃত পণ্যের সঙ্গে পরিবাহিত হয়ে ধ্বংসাÍক পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের জীবাণু দেশের অভ্যন্তরে বা আমাদের দেশে আসা রোধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্য দেশ থেকে অনুপ্রবেশ করা যে কোনো ক্ষতিকর রোগবালাই আমাদের কৃষির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, দানাদার, কন্দসহ প্রায় সব খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। এক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের ৬৪টি জেলার ৫০০ উপজেলায় কাজ করছে। ইতিমধ্যে নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকিমূল্যে ৩৫ হাজার ৩৬০টি ১২ ধরনের কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৯১২টি কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে। গত এক বছরে শুধু এই যন্ত্র ব্যবহারে কৃষকের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তবে কৃষি ক্ষেত্রে যন্ত্র, জাত উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
আইএমইডির রিপোর্টে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার ১৯৮৯.৩৬ শতাংশ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া রাইস প্লান্টারের ব্যবহার বেড়েছে ৬ শতাংশ, রিপার ১৮৫.১১ শতাংশ, সিডার ৬৯৭.৮৭ শতাংশ, মাড়াই যন্ত্র ১৯৩.৬২ শতাংশ, মেইজ শেলার ২১.২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮-৯ শতাংশ, ফসলের উৎপাদন খরচ কমেছে ৪৫.২৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কৃষি উন্নয়ন প্রসঙ্গে এসিআই অ্যাগ্রো বিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. ফা হ আনসারী বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা কৃষিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। এরা দেশের জললবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি হস্তান্তর ও এর সঙ্গে কৃষকদের পরিচিত করার মধ্য দিয়েই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। সনাতন থেকে বেরিয়ে এসে যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কৃষিতে প্রযুক্তি হস্তান্তরে কাজ করছে। এককথায় সরকারের সঙ্গে একীভূত হয়ে কৃষির উন্নয়নে কাজ করছি আমরা। হঠাৎ করে বা একদিনে আমাদের কৃষির উন্নয়ন হয়নি। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর কৃষি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ আমদানি ও বাজারজাতে বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জমি চাষের পর বীজ বপন, গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ, শস্য কর্তন, শস্য মাড়াই, শস্য ঝাড়াইসহ অন্যান্য কাজে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই যান্ত্রিকীকরণের বহুবিধ সুবিধাদির ফলে সরকারও কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকেছে। কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করছি দেশ ও পরিবেশের কথা চিন্তা করে ধানের জাত উদ্ভাবনে। বাংলাদেশের মানুষের খাবারের জোগান দিতে বিআরআরআই ইতিমধ্যে উদ্ভাবন করেছে ১৪৩টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত। সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ধানের জাত উদ্ভাবনে কাজ চলছে। আমরা দেখছি কোন কোন জেলায় ভালো ধান উৎপাদন হয়। আমরা সেই জাতগুলো নিয়ে এলাকাভিত্তিক জাত উন্নয়ন করব। ফলে এলাকাভিত্তিক খাদ্যচাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। ফলে সময় ও শ্রম বাঁচবে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। বিশেষ করে দেশের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ধান। ফলে ১৯৭১ সালে দেশে যেখানে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি ১৮ লাখ টন, সেখানে ২০২১ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে সোয়া ৪ কোটি টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ‘ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন’ বিষয়ক প্রকল্প পরিচালক শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, কৃষি ও চাষাবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকার পরেও প্রয়োজনীয় পানি ও লবণাক্ততার কারণে কৃষিকাজে খুব একটা অগ্রসর হতে পারছে না উপকূলীয় জেলাগুলো। জলবায়ুর অভিযোজন মোকাবেলায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং নড়াইল জেলায় কৃষিবান্ধব প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কাজ চলছে। এসব এলাকার কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে কিভাবে অল্প পানি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা যায়। একাধারে একই খরচে ২-৩ বছর ফসল উৎপাদন, সেচ খরচ হ্রাস, আগাছা দমন, মাটির রস সংরক্ষণ, রোগজীবাণুর সংক্রমণ হ্রাস বা বালাই দমন, সবল ও সতেজ গাছে অধিক সবজি উৎপাদন প্রক্রিয়া কৃষকদের দেখানো হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, সোলার পাম্পের মাধ্যমে ড্রিপ ইরিগেশনের মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পতিত জমি কৃষির আওতায় আনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা যাতে অব্যাহত থাকে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন করে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করে অর্জিত উন্নয়ন টেকসই করে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট দানাদার শস্যের (চাল- ৪০১.৭৬০+ গম- ১২.০৫৯+ ভূট্টা- ৬৪.২২০) উৎপাদন হয়েছে ৪৭৮.০৩৯ লাখ মে. টন, ডাল জাতীয় ফসলের উৎপাদন হয়েছে ৮.৭৮৬ লাখ মে. টন, তেল জাতীয় ফসল উৎপাদন হয়েছে ১৬.০৪০ লাখ মে. টন, মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন ৪৮.৭৫৫ লাখ মে. টন, আলু উৎপাদন হয়েছে ১০৪.৩১৭ লাখ মে. টন এবং পাট উৎপাদন হয়েছে ৮৪.৫৭৭ লাখ বেল। ফল উৎপাদন হয়েছে ৬২২৫.৫২ লাখ মে. টন। উন্নতমানের ধান, গম, পাট এবং ডাল, তেল ও পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন ও ব্যবহারের লক্ষ্যে কৃষক পর্যায়ে বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী স্থাপন ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের কলাকৌশল বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মানসম্পন্ন ভালো বীজ ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ও মানসম্পন্ন বীজের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL