সজীব হোসেন, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) :
‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল’—এমনই একটি গানের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে চলা মাসব্যাপী মেলায় দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছেন বায়োস্কোপওয়ালা আবদুল জলিল।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে বায়োস্কোপ। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মুঠোফোনের সহজলভ্যতার কারণে প্রায় বিলুপ্ত এই বায়োস্কোপ।
আবদুল জলিল দীর্ঘ ৪০ বছর থেকে বায়োস্কোপ দেখান। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের বায়োস্কোপ দেখার মাধ্যমে আনন্দ দেন এবং বায়োস্কোপ খেলা অনেক শখের একটা বিষয়। বিভিন্ন জায়গায় মেলা হতো। সেখানে ছেলেমেয়েদের খেলা দেখাতেন। তারাও ব্যাপক উৎসাহ পেত। আমি মরে গেলে এই ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ আর কেউ ধরে রাখবেনা।
সোনারগাঁসহ তিনি বাংলা একাডেমিতে বায়োস্কোপ দেখান, সিলেটেও বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন। আবদুল জলিলের মতো আর কেউ বায়োস্কোপ দেখান না। আগে বায়োস্কোপ খেলা দেখাতেন ৪ আনা, ১০ পয়সা করে। এখন দেখান ২০ টাকা করে। সারা দিনে আবদুল জলিলের আয় হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই বয়সে এমন আয় হলে সংসার চলবে না। এই টাকার জন্য কে বায়োস্কোপ খেলা ধরে রাখবে।
ইতিহাসমতে, স্টিফেন্স নামের এক বিদেশি বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখান। ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে স্টিফেন্স কলকাতায় এসেছিলেন। আর তখনই তিনি কলকাতায় প্রথম দেখিয়ে যান বায়োস্কোপ। তারপর তাঁর অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন দুই বছর পর ১৮৯৮ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ এখন প্রায় বিলুপ্ত। আগে গ্রামবাংলার বিভিন্ন মেলা, বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন বায়োস্কোপওয়ালারা। তাঁদের বিভিন্ন ধরনের গানের মাধ্যমে আকৃষ্ট করতেন ছোট–বড় বিভিন্ন বয়সী মানুষকে। এমন এক সময় ছিল, যখন মানুষের একমাত্র বিনোদন ছিল যাত্রাপালা–সার্কাস। কিন্তু যাত্রাপালা–সার্কাস ছিল শুধু বয়স্ক মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ। কিন্তু বায়োস্কোপ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।
একসময় বায়োস্কোপওয়ালারা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যেতেন বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে নিয়ে। তাঁদের পিছু নিত শিশু–কিশোরেরা। গ্রামগঞ্জের মেলায় বায়োস্কোপ দেখতে ভিড় জমাত শিশু–কিশোর এবং গৃহবধূরাও। বায়োস্কোপ দেখার আগে টিকিট কেটে নিতে হতো সবাইকে। বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে ৪ আনা, ১০ পয়সা, চালসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি নিতেন। তারপর শুরু হতো বায়োস্কোপ প্রদর্শনী। বায়োস্কোপের কাহিনীতে থাকত ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘মক্কা-মদিনা’, ‘আগ্রার তাজমহল’, ‘কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ’, ‘তিরবিদ্ধ রক্তাক্ত দুলদুল ঘোড়া’ ইত্যাদি।
আগেকার দিনে বায়োস্কোপ ছিল গ্রামবাংলার মানুষের সিনেমা হল। রংবেরঙের পোশাক পরে হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে গ্রামের সরু রাস্তা ধরে হেঁটে চলতেন বায়োস্কোপওয়ালারা। স্কুল–কলেজেও দেখা মিলত বায়োস্কোপওয়ালাদের। হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হতো বিভিন্ন চিত্রকল্প।
বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে বলে জানান, বাংলাদেশ লোক ও ফাউন্ডেরশনের উপ-পরিচালক এ.কে.এম আজাদ সরকার।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL