১৮-এপ্রিল-২০২৫
১৮-এপ্রিল-২০২৫
Logo
ঢাকা

ভূমিকম্প ঝুঁকিতে ঐতিহাসিক পানাম নগর-সংস্কার কাজে কচ্ছব গতি

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-১২ ১৭:৪৬:২১
...

সজীব হোসেন, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ):
ঐতিহ্য রক্ষায় কোন রকম টিকে আছে ৭’শত বছর আগে ঈশা খাঁ’র শাসনামলে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক পানাম সিটি। ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ শহরের মাঝে দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের দুই পাশে ছোট—বড় ১০২টি ইমারত এক সময় শোভা পেলেও বর্তমানে কোনরকম মাথা উচু করে টিকে আছে মাত্র ৫২টি ভবন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ক’টি ভবন ঠাঁয় দাড়িয়ে সেগুলো রয়েছে ভূমিকম্প ঝুঁকিতে। সরাসরি স্বীকার না করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অকপটে স্বীকার করেছেন, আর্থিক সংকটের কারণে আটকে আছে পানাম সিটি সংস্কার প্রকল্পের কাজ। এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র দুটি (৪ ও ১৩ নং) ভবনের।

স্থানীয় ইতিহাসবিদ, লেখক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ১৯৭৭—৭৮ সালের দিকেও পানাম নগরীর রাস্তার দুই পাশে প্রাচীনকালের প্রায় একই আদলে তৈরি একতলা ও দ্বিতল বিশিষ্ট ১০২টি ইমারত ছিল। ১৯৭৭—৭৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বছরের বিভিন্ন সময় প্রায় অর্ধেক ভবন ধ্বংস হয়। ধ্বসে যাওয়া ভবনগুলোর বেশিরভাগই ধ্বংস করা হয়েছে ব্যক্তিগত লোভ—লালসার কারণে। আর কিছু ধ্বংস হয় প্রকৃতগতভাবে যত্ন বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।

 

স্থানীয় দুলালপুর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ৭৫ উর্ধো ডা. সামসুদ্দিন জানান, পানাম সিটির ধূলোবালিতে গড়াগড়ি দিয়েই তার বেড়ে উঠা। বন্ধুদের সাথে যখন ছোট সময় খেলাধুলা করেছেন, তখন পানাম সিটির ভিতরে ছিল ভূতুরেবস্থা। চারপাশ সবুজ বৃক্ষরাজীর ভেতর নিরিবিলি, শান্ত, সুশীতল এক মনোরম পরিবেশ ছিল। তখন দিনের বেলাতেও অনেকে পানাম সিটির মাঝের রাস্তাটি দিয়ে যেতে ভয় পেতো। ভবনগুলো এতটাই ঘন ছিল যে, ভবন আর গাছের ঢাল—পালায় সূর্যের আলো প্রায় ভেতরে আসতে পারতো না। পানাম সিটির ভেতরে ঢুকলে বাইরের আঁকাশ দেখাও দায় হতো। পাশাপাশি দুই ভবনের মাঝে দিয়ে যেতে শিউরে উঠত গাঁ। প্রতিটি ভবনের ভিতর এবং বাইরের খিলানসহ বিভিন্ন জায়গায় শোভা পেতো নানান চিত্রকর্ম। আর এখন উল্টো চিত্র। প্রায় অর্ধেক ভবনই মাটির সাথে মিশে গেছে। খোলা—মেলা পরিবেশ। যে সকল চিত্রকর্ম ছিল, সেগুলো এখন নেই বললেই চলে। সেসব এখন শুধুই স্মৃতি।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অপর এক বাসিন্দা দাবি করেন, পানাম সিটিতে থাকা বাড়িগুলো বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে ও পরে ১০—১৫ বছরের ইজারা দেয়া হয় এবং পরে নবায়নও করা হয়। মূল বাসিন্দাদের অবর্তমানে বাড়িগুলো অযত্নে ক্ষয়ে যেতে থাকে। তবে, ২০০৪ সাল থেকে সম্ভবত আর নতুন করে ইজারা দেওয়া হয়নি বা নবায়ন করা হয়নি।

তিনি জানান, ২০০৫ সালের দিকে দুটো বাড়ি সম্পূর্ণ ধসে পড়ে। ২০০৪ সালে বিএনপি—জামায়াত জোট সরকারের সময়ও পানাম সিটিতে প্রবেশ মুখে ছিল এক খিলানের একটি ব্রীজ। সেটি ভেঙে সড়ক পথ বানানো হয়। তখন প্রায় বেশিরভাগ ভবনই ছিল নেশাগ্রস্ত আর জুয়ারীদের অভয়াশ্রম।

 

নাম প্রকাশে অুনচ্ছুক স্থানীয় এক লেখক বলেন, ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম নগরী সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরু হয় অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পানাম নগর উদ্ধারের কার্যক্রম। সে সময় অবৈধ দখলদাররা জমিগুলো তাদের দখলে রাখতে বিভিন্ন তালবাহানা শুরু করে। যারা এখানে অবৈধ দখলে ছিল, তারা প্রায় সবাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের হোমড়া—চোমড়া নেতাদের আশ্রয়ে থাকতো। পরে ২০০৯ সালে পানাম নগরীকে সম্পূর্ণভাবে দখল মুক্ত করে স্থানীয় প্রশাসন। তখন পানাম সিটিতে ছোট—বড় ৫২টি ভবনকে চিহ্নিত করে অবৈধ দখল মুক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে তখন প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি ভবনের সংস্কার কাজ শুরু করে। কিন্তু সংস্কারের নামে পানাম নগরীতে ৯টি ভবন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সৌন্দর্য নষ্ট করে। দরপত্রে মুল নকশা ঠিক রেখে চুনের সাথে জাফরি ইট বা জাফরি ইটের গুড়ো দিয়ে সংস্কারের কথা থাকলেও, তা না করে সিমেন্টের সাথে বালু মিশিয়ে ঢালাওভাবে আস্তর দিয়ে সংস্কারের চেষ্টা করে। বিষয়টি স্থানীয় সুশীলসমাজের চোখে পড়লে আন্দোলন ও আপত্তির মুখে তৎকালীণ সেনাশাসিত তত্ত্বাধায়ক সরকার সংস্কার কাজ বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ ছিল, পানাম নগরীর সংস্কার কাজ নিয়ে ওই সময়ে ব্যাপক জালিয়াতি করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। নিজেদের লোকদের কাজ পাইয়ে দেয়া, এ সকল কাজে অভিজ্ঞদের না দিয়ে আনাড়ি ঠিকাদার দিয়ে সংস্কারের নামে নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল পানাম নগরীর প্রকৃত নকশা। অথচ পানাম নগরীর অবিকল নকশা ঠিক রেখে সংস্কার কাজের কথা ছিল। পরে পানাম সিটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিলে ২০১৮ সালে পানাম নগরীর পাঁচটি ভবন প্রাথমিকভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ সংস্কার কাজের জন্য দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানির সাথে যোগাযোগের পর ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও কোরিয়া ইপিজেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিহাক সাং একাধিকবার পানাম নগরী পরিদর্শনে আসেন। ওই কোম্পানির সাথে সংস্কারের চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।

 

তৎকালীণ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী তখন নগরীর ২৬টি ভবনকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত করে প্রতিটি ভবনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ সাইন বোর্ড লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। যা বর্তমানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

 

পানাম সিটির বর্তমান দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা সিয়াম চৌধুরী ‘দৈনিক বাংলা’কে জানান, বর্তমানে পানাম সিটিতে মোট ৫২টি ভবন রয়েছে। এরমধ্যে সিটির মাঝে দিয়ে যে সড়কটি রয়েছে তার একপাশে ৩১টি আর অপর পাশে ২১টি। প্রতিবছর বরাদ্ধ অনুসারে ভবনগুলো সংস্কার হয়। এখন পর্যন্ত সংস্কার করা হয়েছে মাত্র দুটি (৪ নম্বর ও ১৩ নম্বর) ভবন। যার একটি ২০২০—২১ অর্থ বছরে অপরটি ২০২১—২০২২ অর্থ বছরে করা হয়েছে। বাকি ভবনগুলো হয়তো এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতি অর্থবছর দেয়া অর্থ বরাদ্ধ থেকে করা হতে পারে। তবে, কবে নাগাদ শেষ হবে বা নতুন করে বাজেট কবে হবে, বা হবে কি—না,তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।

 

গত ২৩ আগস্ট মোবাইলে কথা হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হালিমা আফরোজের সাথে। তথ্য প্রদানে সময় নিয়ে গত ২৮ আগস্ট দৈনিক দিন পরিবর্তন’কে তিনি জানান, শুধু পানাম সিটিই নয়, যে কোন পুরাতন ভবনই ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকে। সে ক্ষেত্রে পানাম সিটির ভবনগুলোও তার বাইরে নয়।

 

তিনি জানান, গত ২০২০—২১ অর্থ বছরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকা ও ময়মনসিংহের পরিচালনায় পানাম সিটির ১৩ নাম্বার ভবনটি মেসার্স রাজু এন্টারপ্রাইজ ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে এবং পানাম সিটির ৪ নাম্বার ভবনটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ করে মেসার্স প্যাসিফিক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে অপর একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। বাকি ভবনগুলোর সংস্কার বিষয়ে প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো অনুমোদিত হলেই কাজ শুরু হবে।