ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিপুল লোকসানে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করে বিগত পাঁচ বছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে ৬০ হাজার ১৮২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ফলে ভর্তুকি আর লোকসানের ভারে ডুবতে বসেছে পিডিবি।
দেশের সরকারি ও বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে একটি নির্দিষ্ট দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এ জন্য প্রতিটি কেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির আলাদা চুক্তি আছে। এ চুক্তিতে বিদ্যুৎ কিনে নেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। চুক্তি অনুসারে বিদ্যুৎ দিতে না পারলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিডিবিকে জরিমানা দেয়। আর পিডিবি তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে না পারলেও কেন্দ্র ভাড়া নিয়মিত শোধ করতে হয়।
এদিকে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে কেন্দ্র ভাড়ার একটি হিসাব দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর আগের অর্থবছরে দিতে হয়েছিল ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকার মতো। আর শেষ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দিতে হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সব মিলে ২ বছর ৯ মাসে কেন্দ্র ভাড়া শোধ করা হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডর তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকেই দেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। শুরু থেকে এ পর্যন্ত এ খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫৩৪ মেগাওয়াট। এসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি কেন্দ্র থেকে অনেক কম দামে বিদ্যুৎ কিনে তা বিক্রি করেছে কম দামে। ফলে পিডিবি প্রতি বছর গুনতে হয়ছে মোটা অঙ্কের লোকসান। এভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ৬০ হাজার ১৮২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ সময় বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় ১৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৬৮ লাখ ইউনিট। এতে ব্যয় হয় এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর ওই বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবির আয় হয় ৭৯ হাজার ৩০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশই ছিল লোকসান।
পাঁচ বছরে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোয় যে লোকসান হয়েছে, তার ৯৮ শতাংশই ছিল ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫২টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৪২৭ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতে অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রই ফার্নেস অয়েলচালিত।
যদিও গত পাঁচ বছরে উৎপাদন করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয়। আর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর মধ্যে শুধু গ্যাসচালিত কেন্দ্রেই মুনাফা করে পিডিবি। বর্তমানে এ ধরনের কেন্দ্র রয়েছে ৩৬টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ৬৭৩ মেগাওয়াট। আর ডিজেলচালিত কেন্দ্র রয়েছে ছয়টি, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। এছাড়া কয়লাচালিত কেন্দ্র একটি, যার সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট।
পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল পাঁচ হাজার ২১৩ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ ব্যবহার হয়। বেসরকারি এসব কেন্দ্র থেকে ওই অর্থবছর কেনা হয় দুই হাজার ৫৩৬ কোটি ১৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৬৯২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর তা বিক্রি করা হয় ১১ হাজার ৯০৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয় চার হাজার ৭৮৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এরপর (২০১৮-১৯) অর্থবছর বেসরকারি খাতের সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৭৪১ মেগাওয়াট। বেসরকারি এসব কেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যবহার হয় ৫৪ শতাংশ। এতে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় দুই হাজার ৭২০ কোটি ১১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৭৬২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তার বিক্রয়মূল্য ছিল ১২ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকায়। এতে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় আট হাজার ১০৩ কোটি ১২ লাখ টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ৪১১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। সে অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় দুই হাজার ৮৮৬ কোটি ৭৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৭৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর তা বিক্রি থেকে আয় হয় ১৩ হাজার ৬০০ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসান হয় সাত হাজার ১৩১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়। ওই অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় তিন হাজার ৯০৫ কোটি ৯৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ৩১ হাজার ১৭৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর তা বিক্রি হয় ১৯ হাজার ৩৯৮ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ফলে লোকসান দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
এদিকে গত জুনে শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৩৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ব্যবহার হয়েছে ৪৫ শতাংশ। আর গত অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় চার হাজার ৪১১ কোটি ৬৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এতে ব্যয় হয় ৫০ হাজার ১২৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। তা বিক্রি থেকে আয় হয় ২১ হাজার ৭৩৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসান হয়েছে ২৮ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবির লোকসান বেড়েছে ১৬ হাজার ৬০৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা বা ১৪১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মূল কারণ জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া। এ সময় গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১১ টাকা ৩৬ পয়সা। আর তার বিক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ টাকা আট পয়সা।
এর আগের (২০২০-২১) অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল সাত টাকা ৯৮ পয়সা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল পাঁচ টাকা ১২ পয়সা। ২০১৯-২০ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল সাত টাকা ১৮ পয়সা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল চার টাকা ৮৬ পয়সা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল সাত টাকা ৬৩ পয়সা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল চার টাকা ৮০ পয়সা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর বেসরকারি খাতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৫৮ পয়সা এবং গড় বিক্রয়মূল্য ছিল চার টাকা ৮৪ পয়সা।
অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর লোকসান ছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৩০৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছর আট হাজার ৪৫৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর আট হাজার ১৪৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ১১ হাজার ৪৩০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছর ২৫ হাজার ৬৪৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় মোট লোকসান হয় ৫৮ হাজার ৯৮৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
এদিকে পাঁচ বছরে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় লোকসান হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা, কয়লচালিত একমাত্র কেন্দ্রে লোকসান হয়েছে চার হাজার ৪৮১ কোটি টাকা ও সৌরবিদ্যুতের কেন্দ্রগুলোয় লোকসান হয়েছে ৩৭৪ কোটি টাকা। এ সময় গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় মুনাফা হয়েছে ১৫ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল গনমাধ্যমকে বলেন, দেশে একমাত্র পিডিবিই পাইকারিমূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর তা চুক্তিমূল্যে কিনে নেয় পিডিবি। প্রতিষ্ঠানটি সেই বিদ্যুৎ পাইকারি মূল্যে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে। তবে দেশ ও জনগনের স্বার্থে বিদ্যুতের বিভিন্ন খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়ে দাম সহনশীল রাখে। এর মাঝে সঞ্চালন বাবদ হুইলিং চার্জ (মাশুল) নেয় পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। সবমিলিয়ে চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ধরে রাখতে ভর্তুকি দেয়া ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতে অন্য কোন উপায় নেই। আর এসব ব্যয় সামাল দিতে গিয়েই লোকসানে পরে পিডিবি।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL