রাজধানীর কড়াইল বস্তির আলামিন হত্যাকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। দীর্ঘদিনের বস্তির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কড়াইল ইউনিটে নতুন কমিটিকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টার কারণে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কাউন্সিলর মফিজ দীর্ঘদিন ধরে বস্তির নিয়ন্ত্রক। নতুন কমিটি আসাতে তারাও বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া ছিল। কাউন্সিলর কৌশলে তার কর্মীদের মাঠে নামিয়ে নতুন কমিটিকে কোণঠাসা করে রাখার কারণে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কাউন্সিলর চাইলে এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত বলে মতামত তাদের। হত্যাকাণ্ডেরও পরেও একদিনের জন্যও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি।
নিহত আলামিনের পরিবার গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে তার স্বামী হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি মামলা উঠিয়ে নিতে একটি পক্ষ হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।
বনানী থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) নূরে আজম মিয়া বলেন, এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা রিমান্ডে রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্যও আমরা পেয়েছি। বাকিদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার রাতে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তিতে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আলামিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে হামলায় নারীসহ ছয়জন আহত হন। আর মসজিদের ভেতরে কোপানো হয় আলামিনের ভাই নাসিরকে।
বৃহস্পতিবার এ ঘটনায় বনানী থানায় ২২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন আলামিনের মেজো ভাই মো. জুয়েল সরকার। মামলার আসামিরা হলেন- মো. নুর আলম নুরু (৩৮), মোহাম্মদ আলী (৫৫), মো. খাজা (৪৫), মো. আমজাদ (৩০), মো. রাসেল (৩৫), মো. মাহাবুর আলম (২১), মো. কবির (৩৮), মো. মাসুদ রানা (১৯), মো. আলী হোসেন (২৭), মো. আজিজুল (৩২), মো. সেন্টু মৃধা (৫০), মো. শফিকুল ইসলাম রাজু (৪০), মো. মাহবুব আলম (৩৫), মো. তানভীর (২০), মো. মামুন (২০), মো. সাব্বির (১৯), মো. মেহেদী (১৯), মো. ইলিয়াস আহমেদ (২২), মো. শহিদুল (৩৫), স্বাধীন (১৯), মো. নাজির (৪০) ও কাউসার (৫৫)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা ২০/২৫ জনের আসামি করা হয়েছে।
এদের মধ্যে মাহাবুব, আমজাদ, রাসেল, ইলিয়াস, মাসুদ (১) এবং মাসুদ (২) পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে রয়েছে।
জানা যায়, রাজধানীর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কড়াইল ১ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের কমিটির বিরোধিতার জেরে হত্যার শিকার হয়েছেন আলামিন। এমনটাই দাবি করছেন তার স্বজনরা। তার স্ত্রী রিতা আকাতার গতকাল রোববার ক্র্যাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন।
তিনি দাবি করে বলেন, তার স্বামী নিরীহ। দলাদলির কারণে সে এ হত্যার শিকার হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলের গ্রেপ্তার দাবি করে বিচার দাবি করেন।
এদিকে জানা গেছে. ঘোষিত ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিল আলামিনের চাচাতো ভাই জসীমউদ্দীন রিপন। ২২ জুলাই তাকে বাদ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই কমিটির বিরোধিতা করে আসছিল তাদের পরিবার।
বস্তির অন্য বাসিন্দারা বলেছেন, রাজনৈতিক রেষারেষির কারণে খুন হয়েছেন আলামিন।
নিহত আলামিনের ভাই মো. জুয়েল সরকার বলেন, আমাদের চাচাতো ভাই জসীমউদ্দীন রিপন কড়াইল থানা ১ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে গত মাসের ২২ জুলাই কমিটি ঘোষণা করা হয়। আমার চাচাতো ভাইকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা দেয়। এরপর থেকেই তাদের সঙ্গে বিরোধিতা চলে আসছিল।
নিহত আলামিনের বোন আকলিমা আক্তার বলেন, এক মাস ধরে আমার ভাইদের হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল সন্ত্রাসীরা। ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠানেও আমার ভাইদের ওপর হামলা করা হয়।
তিনি জানান, আওয়ামী লীগের কড়াইল বস্তির উত্তর ইউনিটের কমিটি দেওয়া নিয়ে মোহাম্মদ আলী, নুরুসহ ওই গ্রুপের সঙ্গে তার ভাইদের বিরোধ ছিল।
হামলাকারীদের হাত থেকে দুই ভাইকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসে আহত হয়েছেন প্রতিবেশী তিন নারী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের একজন বলেন, ওরা আমাদের বাড়িঘরেও হামলা চালিয়েছে। বর্তমানে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
এলাকাবাসী বলছেন, আওয়ামী লীগের কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটলেও এর পেছনে রয়েছে এলাকার নিয়ন্ত্রণ। আল আমীন ও তার ভাই ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমানের অনুসারী। আর হামলাকারীরা আজাদ নামের আরেকজনের অনুসারী।
দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সিলর বস্তির নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। বস্তি থেকে প্রতি মাসে যে কোটি কোটি টাকা উঠে সবই কাউন্সিলরের লোকজন উঠায়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নিহত আলামিনসহ তার ভাই ছাড়াও দুটি ভাগে বিভক্ত বস্তির রিপন, জুয়েল, এনামুল, সাত্তার লম্বু, মঞ্জুরুল, সুবহান মাওলনা ও আওলাদ। এরা সবাই কাউন্সিলর মফিজের অনুসারী। এছাড়াও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফাও কাউন্সিলরের অনুসারী। সে ও তার অনুসারীদের দিয়ে চাঁদা উঠায়।
অভিযোগ রয়েছে এক সমেয়র যুবলীগ উত্তরের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের ক্যাডাররাই এসব নিয়ন্ত্রণ করে। চঞ্চল বর্তমানে আমেরিকায় থাকে। যুবলীগ নেতা জাহিদ হাসান মিল্কি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সে চার্জশিটভুক্ত আসামি। ঘটনার পরপরই সে পালিয়ে যায়। চঞ্চল আমেরিকা থাকলেও এ এলাকায় তার হয়ে কাজ করে শুটার সোহেল, শহিদুল, জিল্লুর, ডানো বাবু এবং খলিল ওরফে বাড্ডার খলিল। এরাই পুরো বস্তিতে গ্রুপ করে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিমাসে যে পরিমাণ চাঁদা ওঠে এর একটি অংশ পেয়ে যায় কাউন্সিলর মফিজের নিকট। এ কারণে তিনি জনপ্রতিনিধি হয়েও বস্তির সকল অপকর্মে নিশ্চুপ থাকে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমান বলেন, এ হামলার পেছনে রাজনৈতিক কোনো না কোনো নেতার ইন্ধন রয়েছে। না হলে এত বড় ঘটনা ঘটত না। কোনো নেতার ইন্ধনে ঘটেছে, তা আমি জানি। যেহেতু আমি রাজনীতি করি, তাই তার নামটা বলতে পারছি না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর অন্যতম অপরাধের আখড়া হিসেবে পরিচিত কড়াইল বস্তিতে প্রতি ঘরে এক মাসে প্রতিটি লাইটের জন্য ১০০ টাকা, ফ্যানের জন্য ১০০ টাকা, টেলিভিশনের জন্য ২০০ টাকা, ফ্রিজের জন্য ৩০০ টাকা দিতে হয়। গ্যাসের প্রতিটি চুলার জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর পানির লাইন ব্যবহার করতে প্রতিটি পরিবারকে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। পানির জন্য একটি পরিবারকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা গুনতে হয়। এ হিসাবে ৮০ হাজার পরিবারের কাছ থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা আদায় করে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
একটি গ্যাসের চুলার জন্য বস্তিবাসীকে গুনতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সাধারণত একটি চুলা তিনটি পরিবার ব্যবহার করে থাকে। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নেয় প্রায় কয়েক কোটি টাকা।
আর বিদ্যুতের পেছনে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৪০০ টাকা করে গুনতে হয়। এ খাত থেকে সিন্ডিকেট আদায় করে প্রায় ৩ কোটি টাকা। আর ঘরভাড়া বাবদ প্রতিটি ঘর থেকে দেড় হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। এ খাত থেকে ঘরের মালিক এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আয় প্রায় ১১ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার কারবার।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো কিছু কপি করা যাবে না
Website Design & Developed By BATL