২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
অর্থনীতি

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি: ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-০৪ ২৩:৩৭:১৯
...

নিজস্ব প্রতিবেদক:

অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারির মূল্য শুল্কায়নে সরকারের এই দ্বৈত নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। তাই অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়নের দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পর চট্রগ্রাম কাস্টম হাউস খালাস করার সময় ট্যারিফ ভ্যালুতে (ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলার) শুল্কায়ন করে। অন্যদিকে একই এইচএস কোডে যখন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে তাদের শুল্কায়ন করা হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে। এর সম্পূর্ন মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের অনুমতি দেয় কাস্টমস হাউস।

জানা গেছে, বর্তমান পণ্যের ইনভয়েস ভ্যালুর ক্ষেত্রে পণ্যের ওপর আরেপিত কাস্টমস ডিউটি সঠিকভাবে নির্ধারন না করে পণ্যের মূল্য নির্ধারন করে থাকে বিপিসি। এর ফলশ্রুতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পরবর্তী সময়ে বিপিসিকে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের জন্য ডিমান্ড নোট করে থাকে। যেটা বিপিসি তার প্রাইসিং ফর্মুলায় অর্ন্তভুক্ত রাখে না। এখানে সরকারের সঙ্গে এনবিআরের দ্বৈতনীতি পরিলক্ষিত হয়। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দেশে দুই আইন থাকতে পারে না। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি মূল্য শুল্কায়ন একই পদ্ধতিতে হতে হবে। হয় তা ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে, না হয় ইনভয়েস ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে প্রাইসিং ফর্মুলা নির্ধারণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সার্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে যেমন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয় পদ্ধতি চালুর বিকল্প নেই। তেমনই বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় পদ্ধতি চালু করার আগেই অবশ্যই সরকারকে মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সবার জন্য একই নীতিতে মূল্য শুল্কায়ন করতে হবে। তাহলেই অর্থসংকট কেটে যাবে এবং জ্বালানি তেল পাচার রোধ করাও সম্ভব হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্য শুল্কায়নে দ্বৈত নীতির কারণে বেসরকারি তেল আমদানিকারকদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়তি ভ্যাট-ট্যাক্সও দিতে হচ্ছে। বিপিসি জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালুতে শুল্ক মূল্যায়ণ করে যে পরিমাণ শুল্ক (ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলার) দিচ্ছে, বেসরকারি পর্যায়ে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে তারা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। একই দেশে সরকারী ও বেসরকারী শুল্ক মূল্যায়ন পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারেনা।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি (অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা) কার্যকর করার শর্ত দিয়েছিল। কিন্তু এতো দিনেও আইএমএফের এই শর্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। যার ফলে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে এখনো বকেয়া আর্থিক ভর্তুকি পরিশোধের চাপে আছে সরকার। এই অবস্থা চলতে থাকলে চলমান অর্থসংকট থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসতে পারবে না। আইএমএফের এই শর্তপূরণ দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে আর্থিক চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জ্বালানি বিভাগ ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আইএমএফ’র শর্তপূরণে ডিজেল, পেট্রল, অকটেনসহ জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে আগামী এপ্রিল থেকে নিয়মিত সমন্বয় করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যে প্রাইসিং ফর্মুলায় জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়ের কথা ভাবছে সরকার, এতে কখনোই দেশের অর্থসংকট কাটানো যাবে না। এমনকি তেলপাচার রোধ করাও সম্ভব হবে না।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও পেট্রোবাংলার কাছে বকেয়া সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে চরম বেকায়দায় চট্রগ্রাম কাস্টম হাউস। জ্বালানি তেলের শুল্ক হিসেবে বিপুল অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে বারবার চিঠি দিয়েও সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এক চিঠিতে বিপিসি এবং পেট্রোবাংলার কাছে রাজস্ব বকেয়া আটকে থাকার তথ্য উঠে আসে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার ব্যারিস্টার মো. বদরুজ্জামান মুন্সি বলেন, এই অর্থবছরে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে যে বকেয়া রাজস্ব রয়েছে, তা আদায় করা গেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ তাদের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে বলে আমরা আশা করছি।

স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেলের বাজার ছেড়ে দিয়েছি। চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে দেশে জ্বালানি তেলের বাজারে ডাইনামিক প্রাইসিং ব্যবস্থা চালু হবে। আমরা অধিকাংশই পরিশোধিত তেল আমদানি করি যা আমাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। বেসরকারি খাতে রিফাইনারি উন্মুক্ত করে দিচ্ছি একই সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউশনও আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি।’

ঋণের শর্ত কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা দেখতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল গত অক্টোবরে বাংলাদেশে এসেছিল। তখন আইএমএফ মিশনের রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে এ খাতে ভর্তুকি আরও কমাতে মূল্য সমন্বয়ে ফের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন জ্বালানি তেলের প্রাতিষ্ঠানিক দাম নির্ধারণ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও অনেক আগেই অটোমেটেড ফর্মুলা বেইজড সিস্টেমে চলে গিয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে দেশেও বেড়ে যাবে আবার কমলে কমে যাবে। ভারত যে ফর্মুলায় নিয়মিত জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করছে, সেই ফর্মুলায় আমাদের যেতে হবে। এতে দেখা যাবে প্রতিমাসে তেলের দাম পরিবর্তন হচ্ছে। এতে দাম কমলে ভোক্তারা সুবিধা পাবে। এটা করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। কারণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে তেলের চোরাচালানও কমে যাবে।

জানা গেছে, আইএমএফ’র তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড় পেতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করার কথা রয়েছে আগামী জুন মাসে। এর আগে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যালোচনা করবে। তৃতীয় কিস্তির জন্য যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য মোট ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ, যা সাড়ে তিন বছরে সাত কিস্তিতে দেওয়ার কথা। আইএমএফ ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে ধাপে ধাপে তাদের ৩৮টি শর্ত পূরণের অঙ্গীকারের বিনিময়ে।

ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের সময় বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এতে আগামী জুনের আগে সরকারের দেওয়া ভর্তুকির ক্ষেত্রে দুটি বড় শর্ত আছে। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজারে দর ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করার একটি ‘দাম নির্ধারণ কৌশল’ তৈরির কাজ করতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে আইএমএফের দেওয়া শর্ত ও পরামর্শগুলো এখন পর্যালোচনা করছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আবারও আইএমএফের একটি দল আসার কথা রয়েছে। দলটি সফরে আসলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করে ভর্তুকি কমানোর যে শর্ত দিয়েছে তা খতিয়ে দেখবে। ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া নির্ভর করবে শর্ত বাস্তবায়নে কতদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার এ খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর পরও এ খাতে এখনো বকেয়া আর্থিক ভর্তুকি পরিশোধের চাপে আছে সরকার। আইএমএফর শর্তে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু হওয়ার পর বিশ্ববাজারের জ্বালানি তেলের দরের সঙ্গে প্রতি মাসে দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্য সমন্বয়ের প্রক্রিয়াটির এখন চুড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। দাম নির্ধারণ পদ্ধতির বিষয়ে বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তেলের দাম নির্ধারণের দুটি অংশ থাকবে। প্রিমিয়াম (জাহাজ ভাড়া ও অন্যান্য), ট্যাক্স, বিপণন মার্জিন, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি মিলে একটি নির্ধারিত অংশ থাকবে, যা সাধারণত পরিবর্তন হবে না। অপর অংশটি আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়বে বা কমবে। ফর্মুলা প্রণয়নে ভারতের জ্বালানি তেলের দরও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে জ্বালানি তেলের চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশে তেলের দাম ভারতের বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হবে বলেও তারা জানান।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৫০ লাখ মেট্রিক টন।