২১-নভেম্বর-২০২৪
২১-নভেম্বর-২০২৪
Logo
অর্থনীতি

অর্থনৈতিক সূচকে বিস্ময়কর পরিবর্তন

রেজাউল করিম হীরা
প্রকাশিতঃ ২০২৪-০২-১৪ ১৬:২২:৫৮
...

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর অবস্থানও পাল্টে গেছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হচ্ছে। এছাড়া নানা সংকটের মধ্যেও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বেড়েছে ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, টানা পাঁচ মাস ধরে কমে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে। ডিসেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমে আসে, যা আগের সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা ছিল গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে অর্থ বিভাগের চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাজারে মুদ্রা প্রবাহ কমিয়ে আনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা হচ্ছে।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এসেছে। আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বেশ কয়েক দফায় বাড়িয়েছে এবং ঋণের সুদহারের বেঁধে দেওয়ার সীমাও তুলে দিয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার প্রায় ২০ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে।

প্রথম প্রান্তিকে বাজেট ঘাটতি না হয়ে বরং উদ্বৃত্ত হয়েছে। এ সময় ঘাটতি বাজেট পূরণে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ না নিয়ে পরিশোধ করা হয় ৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ শোধ করা হয় ৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে নতুন ঋণ না নিয়ে আগের নেওয়া ঋণ থেকে ৩৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরের ওই সময়ে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়েছিল ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে ১৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে নিয়েছিল ১১ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আগের ঋণের স্থিতি থেকে পরিশোধ করেছে ২৪ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা।

তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ক্রয়াদেশ বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মুদ্রাস্ফীতি কমেছে। এ কারণে পোশাক রপ্তানির অর্ডার বাড়ছে। তারা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে আরও বেশি অর্ডার পাবেন।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর মুখপাত্র ও পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, এটি সত্যি খুশির খবর যে একক মাস হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে এই প্রথম ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি মাইলফলক স্পর্শ করেছে এই খাত। বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দিকটি হলো, আমরা ধীরে ধীরে আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হচ্ছি এবং অত্যাধুনিক আইটেমগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যা আয় বৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে প্রবাসীরা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২০১ কোটি ডলার বা ২ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। একক মাস হিসেবে জানুয়ারিতে আসা রেমিট্যান্স গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগের মাস ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি এবং গত জানুয়ারিতে ১৯৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির প্রবণতা এখনও চলমান। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম ৯ দিনে প্রবাসীরা ৬৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে আসছে ৭ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি মূল্য সদ্য বিদায়ী জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে।

ইপিবির হিসাবে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কম।

গত অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে রপ্তানি ছিল ৩২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৭ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য থেকে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের (৪.৯৭ বিলিয়ন) পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। পোশাক রপ্তানির ইতিহাসে একক মাস হিসেবে এটাই সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা- যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের সুদ বাড়ার কারণে আমানতের সুদ হার বেড়ে গেছে। আর আমানতের সুদ হার বাড়ার কারণে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন সুদ আয়-নির্ভর আমানতকারীরা। ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় নেমেছে। তিন মাস আগে গত সেপ্টেম্বর শেষে যা ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো আদায় জোরদার, পুনঃতফসিল, অবলোপনসহ বিভিন্ন উপায়ে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে বলে জানা গেছে।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, অর্থনীতিতে কিছু সংকট থাকলেও বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উন্নয়নের পথে ফিরতে শুরু করেছে। গত সোমবার সচিবালয়ে তিনি বলেন, আমরা সঠিক পথে ফিরেছি, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর রাতারাতি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা নয়। সে জন্য কিছুটা সময় লাগবে।